সিলেট মিরর ডেস্ক
মার্চ ১৬, ২০২৩
১১:১২ অপরাহ্ন
আপডেট : মার্চ ১৭, ২০২৩
০১:৪৯ অপরাহ্ন
‘হুরুতার বাফ ২৫ বছর আগে মারা গেছইন। চাইরগু বাইচ্চা লইয়া খাইয়া-না খাইয়া দিন কাটাইরাম। ইদিকে পুরি বিয়ারলাখ অইছে। হাতো টেখা-পয়সা নাই, খেত-কৃষিও নাই। পুরির বিয়ার চিন্তায় রাইত ঘুম আইতো না। পয়সা নায় দেখি ভালা জামাইও পাইছলাম না। অউ সময় আল্লাহর হুকুমে বড় বিপদ থাকি উৎরাইছি। মা অইয়া একখান ফরয আদায় করলাম। দেশ-বিদেশোর বউত মাইনষে হুনছি ইখানো দান-খয়রাত করছইন। তারার লাগি দোয়া রইলো।’ - কথাগুলো বলছিলেন সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার লেংগুড়া গ্রামের মৃত হরমুজ আলীর স্ত্রী সবিলা বেগম।
কানাইঘাটের দূর্গাপুরের আলী আহমদ নিজের সামান্য জমি চাষের পাশাপাশি অন্যের জমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এতে কোনরকমে পাঁচজনের সংসার চললেও টাকার অভাবে মেয়ের বিয়ে দিতে পারছিলেন না। ভালো পাত্রের সন্ধান পেলেও দরিদ্র পরিবারের মেয়ের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে তারা আগ্রহী হতেন না। ২২ বছরেরর মেয়ে কুলসুমা খাতুনকে নিয়ে তাই আলী আহমদের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। ছেলেকে নিয়ে একই পরিস্থিতিতে ছিলেন গোয়াইনঘাটের জমির উদ্দিন। স্থানীয় বাজারে জ্বালানী কাঠ বিক্রি করে সংসার চালালেও ছেলের বিয়ে করাতে পারছিলেন না টাকার অভাবে।
সবিলা বেগম, আলী আহমদ, জমির উদ্দিনের মত হতদরিদ্র ৬০ পরিবারের নিরাশার জীবনে নতুন আশার আলো ছড়িয়ে দিয়েছে আল খায়ের ফাউন্ডেশন ও প্রতিদিনের বাংলাদেশ। গতকাল বৃহস্পতিবার সিলেট বিভাগের এমন অসহায় পরিবারে ছেলে-মেয়েদের যৌতুকমুক্ত বিয়ের জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে ৩০ জোড়ার নবজীবনের দ্বার উন্মোচন করে দেয়। নগরীর অভিজাত আমান উল্লাহ কনভেশন হলে ৬০ পরিবারের স্বজনদের নিয়ে ব্যতিক্রমী আয়োজনে জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার রসদ হিসেবে দেওয়া হয় নানা উপহার। এসবের মধ্যে ছিল, রিকশা, সেলাই মেশিন, বিছানা, গৃহস্থালী সামগ্রী, খাদ্য সামগ্রীর পাশাপাশি দাম্পত্যের শুভসূচনার জন্য নগদ অর্থ।
জৈন্তাপুর বাল্লা গ্রামের রাসেল আহমদ রাজমিস্ত্রীর কাজ করে কোনরকমে দিন কাটালেও বিয়ে করার সামর্থ্য ছিল না। তিনি জানান, স্থানীয় একজনের মাধ্যমে যৌতুকমুক্ত বিয়ের কথা জানতে পারেন। এরপর পারিবারিকভাবে পাত্রী ঠিক করা হয়। অবশেষে আল খায়ের ফাউন্ডেশন ও প্রতিদিনের বাংলাদেশের সহযোগিতায় স্ত্রীকে নিয়ে নতুন জীবন শুরুর সুযোগ পাওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রাসেল বলেন, অখন নিজোর রিকশা চালাইমু। বউয়ে সেলাই মেশিন দিয়া কাপড় সিলাই করব। দুইজনে মিলিয়া কাম করলে সংসারে অভাব থাকতো নায়।
কানাইঘাটের রায়পুর গ্রামের লিমা আক্তারের বাবা শুক্কুর আলী পেশায় রিকশা চালক। লিমার সমবয়সীদের সবার বিয়ে হলেও দরিদ্র শুকুর আলীর পক্ষে মেয়ের বিয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। গতকালের আয়োজনে অংশ নিয়ে শুক্কুর আলীর পুরো পরিবার ব্যাপক খুশি। তারা বলেছেন, যাদের সহযোগিতায় নতুন জীবন মিলেছে, তাদের সকলের জন্য দোয়া রইলো।
এভাবে ৩০টি পরিবারের নতুন জীবনের শুভক্ষণে সহযাত্রী হতে পারার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে আল খায়ের ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি ডিরেক্টর তারেক মাহমুদ সজীব বলেন, ২০১৬ সাল থেকে আল খায়ের ফাউন্ডেশন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহ জনকল্যাণমূলক কাজ করে যাচ্ছে। বিগত বন্যায় সিলেটে ১০ হাজার পরিবারকে ত্রাণ সামগ্রী ও ২৫ হাজার মানুষকে রান্না করা খাদ্য বিতরণ করে। আজ সিলেটে যৌতুকমুক্ত বিয়ে দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। দেশ-বিদেশের নানাপ্রান্তের মানুষের সহযোগিতায় আনন্দময় আয়োজন সম্ভব হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও কয়েক’শ গরীব পরিবারকে বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
দিনব্যাপী আয়োজনের শেষপর্যায়ে শুভকামনা জ্ঞাপন অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন প্রতিদিনের বাংলাদেশ’র ফিচার সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম আবেদ। অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে শুভেচ্ছা বক্তৃতা করেন আমান উল্লাহ কনভেনশন হলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ কুদরত উল্লাহ ফাহের।
নবদম্পত্তিদের শুভকামনা ও আশিস জানিয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশ’র সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি বলেন, প্রতিদিনের বাংলাদেশ সূচনালগ্ন থেকে সংবাদ প্রকাশের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে মানবিক নানা কাজ করছে। তিনি বলেন, আজকে যৌতুকমুক্ত ৩০ জোড়ার বিয়ের আয়োজনের মাধ্যমে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। সিলেট থেকে যৌতুকমুক্ত বিয়ের এই যাত্রা শুরু হয়েছে; তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। নবদম্পতি ও তাদের স্বজনদের উদ্দেশ্যে তিনি আরও বলেন, যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি। এর বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। আজকে যারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন, তারা সারাজীবন যৌতুকের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবেন বলে আশা করি। নব দম্পতিকে দেওয়া উপহার সামগ্রী তাদের পরিবারের জীবিকা নির্বাহে সহযোগিতা করবে বলে মন্তব্য করেন।