আরব বিশ্বের বাইরে ফিলিস্তিনদের বাস কোন দেশে বেশি

সিলেট মিরর ডেস্ক


নভেম্বর ১৯, ২০২৩
০৩:৪৩ পূর্বাহ্ন


আপডেট : নভেম্বর ১৯, ২০২৩
০৩:৪৩ পূর্বাহ্ন



আরব বিশ্বের বাইরে ফিলিস্তিনদের বাস কোন দেশে বেশি


গাজা বা পশ্চিম তীর থেকে দূরত্ব ১৩ হাজার কিলোমিটারের বেশি। কিন্তু আরব বিশ্বের বাইরে যে দেশটিতে সর্বোচ্চ সংখ্যক ফিলিস্তিনি থাকেন সেটি হল দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলি- যেখানে প্রায় পাঁচ লাখের মতো ফিলিস্তিনি বসবাস করেন।

চিলিতে বসবাসকারী এই ফিলিস্তিনিরা সেখানে থেকেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জোরালো আওয়াজ তুলছেন। খবর বিবিসিরএক মাস আগে ইসরায়েল-হামাস সংঘাতের পর থেকে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে হাজারো ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার বিক্ষোভ করেছে।

সবশেষ শনিবারেও তারা ফিলিস্তিনের ঐতিহ্যবাহী স্কার্ফ 'কুফিয়া' পরে প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতিবাদ করেছে। প্রতিকূলতা, নিপীড়নের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার মতো বা ‌'এটা যুদ্ধ নয়, গণহত্যা' এমন প্রতিবাদী নানা স্লোগান দিয়ে তারা মুখর করে তোলে সান্তিয়াগোর রাস্তা।

চিলিতে বাস করা ফিলিস্তিনিদের অনেকেরই আত্মীয়স্বজন গাজা উপত্যকায় বা এর কাছাকাছি থাকে। ইসরায়েল সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করার পর সেসব স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করাটাও তাদের জন্য কঠিন হয়ে গেছে। তারা পুরো সংকটটাকে অন্তর থেকে অনুভব করে।

'গাজায় যা হচ্ছে সেটা আমাদের মনে নাড়া দিয়েছে। সেখানের অবস্থা দেখে আমরাও আক্রান্ত হচ্ছি,' মুন্ডোকে বলছিলেন চিলির ফিলিস্তিনি কমিউনিটির নির্বাহী পরিচালক ডিয়েগো খামিস।

দক্ষিণ আমেরিকায় দেশটিতে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ভেরা বাবুন জানান, 'ঐতিহাসিকভাবেই ফিলিস্তিনে ঘটা সব ধরণের নৃশংসতার বিরুদ্ধে চিলির ফিলিস্তিনিরা সোচ্চার।'

কিন্তু কীভাবে চিলির লোকজনের সাথে ফিলিস্তিনিদের সাথে এতটা সুসম্পর্কের বন্ধন গড়ে উঠলো? এতো বেশি সংখ্যক ফিলিস্তিনিই বা কেন এত দূরের একটা দেশে পাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো?


চিলিতে কেন?

চিলিতে ফিলিস্তিনিদের অভিবাসন বুঝতে উনবিংশ শতকের শেষ দিকে যেতে হবে। জর্ডান নদী আর ভূমধ্যসাগরের মাঝে ফিলিস্তিন অঞ্চল শাসন করত অটোমানরা। মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিস্টান, সবার জন্যই জায়গাটা পবিত্র।

'ফিলিস্তিনি, সিরিয়ান এবং লেবানিজরা এক অর্থনৈতিক সংকটের মাঝে দেশ ছেড়ে যেতে শুরু করে। তখন এ অঞ্চলে অটোমান সম্রাজ্যের পতন ও প্রথম আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দমনের সময় চলছিলো,' বলছিলেন রিকারডো মারজুকা, যিনি ইউনিভার্সিটি অফ চিলির সেন্টার ফর অ্যারাব স্টাডিজের একজন শিক্ষাবিদ।

বিবিসি মুন্ডোকে ২০২১ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে একথা বলেছিলেন তিনি।

ফিলিস্তিনিদের মতো অনেকেই তখন সম্ভাবনাময় 'নতুন বিশ্ব' হিসেবে আমেরিকার দিকের দেশগুলোকে দেখতে শুরু করেন।

অনেক তরুণ ফিলিস্তিনিরা তখন স্থলপথে ইউরোপ এরপর সেখান থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসে যেতে থাকে।

আর্জেন্টিনার রাজধানী ছিল তুলনামূলক ধনী এবং ইউরোপের মতো। কিন্তু সেখান থেকেও অনেকে আন্দিজ পাড়ি দিয়ে চিলির দিকে যেতে থাকে। হয়তো একরকম অজানা গন্তব্যের আকর্ষণেই।

১৮৮৫ থেকে ১৯৪০ সালের মাঝে চিলিতে আট থেকে দশ হাজারের মতো আরব ছিল। এই তথ্য লেখক লরেঞ্জো আগার করবিনসলার বই ‘দা অ্যারাব ওয়ার্ল্ড ইন ল্যাটিন আমেরিকা’র।

সেই আরবদের অর্ধেকই ছিল ফিলিস্তিনি যাদের অধিকাংশই তিনটি শহর থেকে এসেছিল - বেথলেহেম, বেইত জালা আর বেইত সাহুর। তিনটি শহরই জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে (ফিলিস্তিনের ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক অংশ) অবস্থিত।

কিন্তু এরপর ভিন্ন ধরনের অভিবাসন শুরু হলো। যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যেতে শুরু করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে যখন ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের দিনটি ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়ের দিন হিসেবে পরিচিত, কারণ তখন তাদের জন্য এক জাতীয় সংকটের শুরু হয়। সেই সময় প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনিদের হয় অন্য দেশে পালাতে হয় নয়তো ইহুদি সেনাদের দ্বারা বিতাড়িত হতে হয়।

নব্য অনেক দেশের মতো চিলির অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে এবং তাদের ভূখণ্ডকে জনবহুল করতে অভিবাসীদের প্রয়োজন ছিল। চিলির অভিজাতরা সাধারণত ইউরোপীয়দের পছন্দ করত, যাদেরকে উনবিংশ শতকের শুরু থেকে ভূমি ও নানা অধিকার দেওয়া হয়েছিল। তবে সেটার সুযোগ নেয় অনেক ফিলিস্তিনি এবং অন্যান্য আরবরা।

'এটা এক ধরনের চেইন এফেক্টের মতো ছিল, কোনো একটা দল চিলিতে আসতো, সাথে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে আসতো' বলছিলেন মারজুকা।

এই আবাসনের পেছনে বেশ কয়েকটি বিষয় কাজ করার কথা জানান তিনি। একটি হচ্ছে জলবায়ু, কারণ চিলির আবহাওয়ার সাথে ফিলিস্তিনের বেশ মিল রয়েছে। আরেকটি হচ্ছে 'স্বাধীনতা যেটা অটোমান ও পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দমনের কারণে তাদের জীবনে ছিল না!' আরও একটি কারণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, বলছিলেন শিক্ষাবিদ মারজুকা।

যারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছিল তারা বাণিজ্য এবং টেক্সটাইল শিল্পকে বেছে নিয়েছিল যেটা এ অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রাখবে।

তারা তাদের ঐতিহ্য অনুসরণ করেছিল। তারা দর কষাকষি করতে জানত। একই সাথে তারা একটা প্রয়োজনীয় চাহিদাও পূরণ করেছিল। তারা তাদের সাথে পণ্য নিয়ে এসেছিল। চিলির গ্রাম বা শহরাঞ্চলে কেনার মতো খুব বেশি কিছু ছিল না।

'প্রথম দিকে ফিলিস্তিনিরা রাস্তার ধারে বিক্রি-বাট্টা শুরু করে। সেখান থেকে ছোট ব্যবসা, তারপর টেক্সটাইল উন্নয়নে এই পরিবারগুলির একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল,' বলেন মারজুকা।

ফলে আবুমোহর পরিবারের প্রথম সদস্যরা চিলির ব্যবসার জগতে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় ও ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাণিজ্য, আর্থিক খাত এবং এমনকি ফুটবলের ব্যবসার সাথেও তাদের নাম জুড়ে আছে এবং তারা দেশজুড়ে ঘুরে ঘুরে পাইকারি পণ্য বিক্রি করে।


এএফ/০২