পাকিস্তানে নির্বাচন: সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মধ্যেই ইমরানের চমক

সিলেট মিরর ডেস্ক


ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৪
০৪:২১ পূর্বাহ্ন


আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৪
০৪:০৩ অপরাহ্ন



পাকিস্তানে নির্বাচন: সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মধ্যেই ইমরানের চমক


তাঁকে গুলি করা হয়েছে। এরপর পাঠানো হয়েছে জেলে। তাঁর রাজনৈতিক দলকে কার্যত নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং মূলধারার মিডিয়া থেকে মুছে ফেলা হয়েছে নাম। তবে শেষ করা যায়নি ইমরান খানকে। 

পাকিস্তানে বৃহস্পতিবারের নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, সেনাবাহিনীর নজিরবিহীন দমনপীড়ন এবং বেশুমার জালিয়াতির অভিযোগের মধ্যেই ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) পার্টির সঙ্গে যুক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জাতীয় আইনসভায় অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন।

  নির্বাচনে পিটিআইর বিখ্যাত ক্রিকেট-ব্যাট প্রতীক নিষিদ্ধ করেছে সেনানিয়ন্ত্রিত সরকার। তারপর ইমরানের জয়ের আশঙ্কায় ভোটের দিন দেশব্যাপী মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে নির্বাচন পরিচালনা করা পিটিআই। সত্যিকার জনমতের প্রতিফলন প্রকাশ রোধে নিষিদ্ধ করা হয় বুথ ফেরত সমীক্ষাও। পিটিআই নেতারা অভিযোগ করেছেন, তাদের এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে বাধা দেওয়া হয়। সর্বশেষ কৌশল হিসেবে ভোটের ফলাফল প্রকাশে অস্বাভাবিক দেরি করা হয়। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এটা ছিল অত্যন্ত সন্দেহজনক পদক্ষেপ।

অবশেষে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ১০ ঘণ্টা পর ফলাফল আসতে শুরু করে। তাতে দেখা যায়,  তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজকে (পিএমএল-এন) ব্যাপক ব্যবধানে পেছনে ফেলেছে পিটিআই। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) আছে তৃতীয় স্থানে। নওয়াজ পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর পছন্দের প্রার্থী।

বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বিকেল ৫টায় ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত পার্লামেন্টের ২৬৬টি আসনের মধ্যে ২২৪টির ফল প্রকাশ করেছে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন (ইসিপি)। 

পাকিস্তানের জিও নিউজ জানায়, এসব আসনের মধ্যে পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৯১টি আসনে জয় পেয়েছে। বিপরীতে পিএমএল-এন প্রার্থীরা ৬৪ এবং পিপিপি প্রার্থীরা ৫০টিতে জয় পেয়েছে। ৪১টি আসনের ফল প্রকাশ হয়নি এবং একটিতে ভোট স্থগিত করা হয়েছে।

জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য একটি দলকে অন্তত ১৩৩টি আসনে জয় পেতে হবে। কিন্তু বিশ্লেষকদের ধারণা, সেনাবাহিনীর কারসাজিতে এবারের ভোটে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। ফলে দলগুলোকে জোট গঠনে ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। গঠিত হতে পারে ঝুলন্ত সংসদ। এটা ছিল সেনাবাহিনীর শেষ বিকল্প। 

জাতীয় পরিষদের পাশাপাশি ২৯৬ আসনের পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদ, ১৩০ আসনের সিন্ধু, ১১৩ আসনের খাইবার পাখতুনখোয়া এবং ৫১ আসনের বেলুচিস্তানের জন্য ভোট গ্রহণ করা হয় বৃহস্পতিবার। সব মিলিয়ে এ নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন প্রায় ১৮ হাজার। 


ফল প্রকাশে বিলম্বে সংশয়

পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন (ইসিপি) কোনো বিলম্ব না করেই নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করার প্রতিশ্রুতি দিলেও কয়েক ঘণ্টার বিলম্ব বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এতে বেশ কয়েকটি দল সন্দেহ প্রকাশ করেছে।

ভোট বন্ধ হওয়ার ২৮ ঘণ্টা পরও ইসিপি জাতীয় পরিষদের পূর্ণাঙ্গ ফল ঘোষণা করতে পারেনি। এতে ক্ষুব্ধ ৪৫ বছর বয়সী দোকান মালিক নিসার আহমেদ এএফপিকে বলেন, ‘বিলম্বের এই কৌশল উচ্চস্বরে বলে দিচ্ছে যে, ফলাফলে কারচুপি হয়েছে এবং দেরির পেছনে অন্য কোনো কারণ নেই।’ বিভিন্ন দলের নেতারাও একই অভিযোগ করেছেন।


সরকার গঠনের প্রত্যয় পিটিআইর

পাকিস্তানে এরই মধ্যে জোট সরকার গঠন নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা। তবে পিটিআইর প্রভাবশালী নেতা ব্যারিস্টার গহর আলি খান দাবি করেছেন, পিটিআই জাতীয় পরিষদে ১৫০ আসনে জয়ের কাছাকাছি রয়েছে। তাই কেন্দ্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করবেন তারা। ব্যারিস্টার গহর জিও নিউজকে বলেন, ‘আমরা পিপিপি বা পিএমএল-এনের সঙ্গে (জোট সরকার গঠনের জন্য) যোগাযোগ করছি না।’

তিনি বলেন, পিটিআই পাঞ্জাবেও সরকার গঠন করবে। এ ছাড়া খাইবার পাখতুনখোয়ায় পিটিআই স্পষ্ট ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছে এবং সেখানেও সরকার গঠন করবে। পিটিআই সংসদে থাকবে এবং তার ভূমিকা পালন করবে।’ হর্স ট্রেডিংয়ের আশঙ্কার মধ্যে পিটিআইর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দলীয় নির্দেশের বিরুদ্ধে কোনো দলে যোগ দেবেন না বলে জানান গহর।

পিএমএল-এনের সিনিয়র নেতা ইসহাক দার দাবি করেছেন, বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাঁর দলের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। নওয়াজ শরিফ ‘বিজয় ভাষণ’ দিতে চলেছেন বলে তাঁর দল দাবি করেছে।

ইসলামাবাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষক রফিউল্লাহ বলছেন, স্বতন্ত্ররা তাদের মনমতো দলে যোগ দেওয়ার জন্য সময় পাবেন তিন দিন। যেহেতু পিটিআই কার্যকর কোনো রাজনৈতিক দল নয়, দলটির নেতা ইমরান খান জেলে আছেন, সে কারণে দলটির অনুসারীদের অন্য একটি রাজনৈতিক দলেই যোগ দিতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পিপিপি এবং পিএমএল-এন– দু’দলই তাদের দলে স্বতন্ত্রদের যোগ দেওয়ার জন্য আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

রফিউল্লাহ বলেন, এ পরিস্থিতিতে স্বতন্ত্রদের জন্য দুটো বিকল্প সামনে আছে। এক. বিলাওয়ালের পিপিপির সঙ্গে জোট গড়া এবং আরেকটি ছোট পার্টি গড়া। আর দুই. এই স্বতন্ত্রদের পিটিআইতে যোগ দেওয়ানো হতে পারে।


সামনে কী

২০২২ সালের এপ্রিলে সেনা সমর্থিত অনাস্থা ভোটে ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তার পর তিনি একটি হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ১৮০টিরও বেশি মামলা দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তিনটি মামলায় তাঁকে ৩১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সরকার ও পাবলিক পলিসির সহযোগী অধ্যাপক মায়া টিউডর বলেন, পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর নিরঙ্কুশ সমর্থন ছাড়া কেউ শাসন করতে পারে না। তবে এবার যা আলাদা, তা হলো সামরিক বাহিনী প্রকাশ্যে পিটিআইকে টার্গেট করছে। কারণ তৃণমূলে তাদের সমর্থন রয়েছে এবং তারা প্রযুক্তি সচেতন।

উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান টাইম ম্যাগাজিনকে বলেছেন, এটা খুব স্পষ্ট যে, সামরিক বাহিনী নার্ভাস ছিল এবং তার পরে ফলাফলে পিটিআইর প্রত্যাশা ছাড়িয়ে যাওয়া (তাদের জন্য) একেবারেই এক বড় ধাক্কা।

তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী চায় পরবর্তী সরকার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের দিকে মনোনিবেশ করুক এবং স্পষ্টভাবে আশা করে, এটি ইমরান খানকে আরও কয়েক বছরের জন্য জেলে রেখে দিতে। তবে তাদের চ্যালেঞ্জ কেবল বাড়তে চলেছে। কারণ পিটিআইর ঘাঁটি আরও সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে।’

পোলিং গ্রুপ গ্যালাপ পাকিস্তানের নির্বাহী পরিচালক বিলাল গিলানি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, পিটিআই সরকার গঠন করতে না পারলেও এ নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে তাদের রাজনৈতিক কূটকৌশলেরও সীমাবদ্ধতা আছে। দেখা যাচ্ছে, সামরিক বাহিনীও সব সময় পথ খুঁজে পায় না– এটাই আশার কথা।

দেশটির সিনিয়র সাংবাদিক হামিদ মীর জিও নিউজে এক নিবন্ধে লিখেছেন, ইমরানকে জেলে পুরে নির্বাচনে অযোগ্য এবং দোষী সাব্যস্ত করা হলেও রাজনীতি থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া যায়নি। এর আগে নওয়াজ শরিফ আদালতে দোষী সাব্যস্ত ও অযোগ্য হওয়ার পর ফিরতে পারলে ইমরান খান কেন নয়? নওয়াজ শরিফ উচ্চ আদালত থেকে মুক্তি পেতে পারলে ইমরান খান কেন নয়?


এএফ/০৩