বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ
সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৪
০৯:৪২ অপরাহ্ন
আপডেট : সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৪
০৫:২৬ অপরাহ্ন
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনিক ভবন ও হলরুম নির্মাণ কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি ও দায়িত্বহীনতার অভিযোগ উঠেছে। বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও যথাসময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় উপজেলা প্রকৌশলীর কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। এ ছাড়া সাচনা-জয়নগর এবং সেলিমগঞ্জ-গাগলাজুর সড়কের কাজেও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আছে। এসব কাজে উপজেলা এলজিইডির উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সদ্য বিদায়ী) মো. আনিছুর রহমান ও অফিস সহকারী মো. মোফাজ্জল হোসেন মিলনের দিকে অভিযোগের তীর উঠেছে।
উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ছত্রছায়ায় তারা দীর্ঘদিন ধরে এলজিইডির প্রায় প্রকল্পে আধিপত্য বিস্তার করায় জামালগঞ্জে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর এদের বিরুদ্ধে মানববন্ধনের পাশাপাশি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে স্মারকলিপিও প্রদান করে একটি স্থানীয় সংগঠন।
জানা যায়, গত ২ জুলাই এক চিঠিতে উপজেলা প্রশাসনিক ভবন ও হলরুম নির্মাণ কাজে অবহেলা ও অদক্ষতার বিষয়টি উল্লেখ করে উপজেলা প্রকৌশলীর কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। ৬ কোটি ৭১ লাখ ৫৪১ টাকার এ কাজ বাস্তবায়নে ২০২০ সালের ১৫ জুন প্রাক্কলন অনুমোদনের পর ঠিকাদার নির্বাচন শেষে ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল কার্যাদেশ দেয় উপজেলা এলজিইডি।
পরবর্তী সময়ে ২০২৩ সালের ১৫ জুন বর্ধিত সময়েও প্রশাসনিক ভবনের কাজ শেষ না হওয়ায় কয়েক দফা তাগিদ দিয়েছে এলজিইডি ঢাকা অধিদপ্তর। তাদের এমন খবরদারিতে পরিস্থিতি বেগতিক বোঝে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রশাসনিক ভবন নির্মাণে বরাদ্দকৃত ৭৬ লাখ ৪২ হাজার টাকা ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ জন্য গত ৮ জুলাই ঢাকা অধিদপ্তর উপজেলা এলজিইডির কাছে কৈফিয়ত তলব করে। এক্ষেত্রে উপজেলা প্রকৌশলী কৈফিয়তের শিকার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে সদ্যবিদায়ী উপ-সহকারী প্রকৌশলী আনিছ।
অফিসের এক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, প্রশাসনিক ভবন ও হলরুম নির্মাণ কাজে অঘোষিত ‘সাব-কন্ট্রাক্টর’ ছিলেন উপ-সহকারী প্রকৌশলী আনিছ। এতে কামাল এন্টারপ্রাইজের নাম কাগজে-কলমে থাকলেও আসল কাজের কাজী মূলত তিনি। এ কাজে পছন্দের সহ-ঠিকাদার নিয়োগ, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, ভবন নির্মাণে মাল-মসলা ব্যবহারে অনিয়ম, নির্ধারিত সময়সীমার ব্যত্যয়সহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে আনিছের। তার অপতৎপরতার কারণে প্রশাসনিক ভবনের কাজ সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেনি অভিযোগ সূত্রের।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রশাসনিক ভবন ও হলরুম নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে সেখানে। কর্মস্থলে কোন শ্রমিক কিংবা দায়িত্বশীল কাউকে খোঁজে পাওয়া যায়নি। বর্ধিত সময় পার হলেও চারতলা ওই বিল্ডিংয়ের আস্তর, দরজা-জানালা, টাইলসসহ আনুষাঙ্গিক অনেক কাজ বাকি আছে। নির্মিতব্য ভবনের অবয়বটুকু শুধু দাঁড় করানো হয়েছে। আদৌ কাজ শুরু হবে কি-না, শুরু হলেও কবে নাগাদ শেষ হবে তার কোন সন্তোষজনক আলামত চোখে পড়েনি।
অন্য কাজ সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে আরও জানা যায়, সেলিমগঞ্জ-গাগলাজুর জিসি ভায়া আলীপুর সড়ক এবং সাচনা জিসি জয়নগর ভায়া রামনগর বাজার সড়কের কাজেও অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে-হচ্ছে। ২০২৩ সালের ২০ জুলাই তৎকালীন উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল মালেক মিয়া (বর্তমানে অবসরে) জামালগঞ্জের সেলিমগঞ্জ-গাগলাজুর-আলীপুর সড়কের কাজ তদারকির জন্য এক অফিস আদেশ প্রদান করেন। তাতে কার্যসহকারী থাকার পরও অফিস সহকারী মিলনকে কার্যসহকারী বানানো হয়। ৩ কোটি ৪৪ লাখ ৬২ হাজার ৩১৭ টাকার ওই প্রকল্প থেকে ঠিকাদারদের নিম্নমানের সুযোগ সুবিধা দিয়ে নিজেদের পকেট ভারি করতেই তাদের এ প্রচেষ্টা বলে জানা গেছে।
সাচনা-জয়নগর সড়কের কাজ নিম্নমানের হচ্ছে জানিয়ে নূরপুর গ্রামের বাসিন্দা রেজওয়ান আহমেদ আলম বলেন, ‘এই সড়কের কাজ যেভাবে হচ্ছে তা টেকসই হবে না। বরং আগের সড়কটাই ভালো ছিল। স্থানীয়রা এ কাজে সন্তুষ্ট নয়।’
এদিকে, সাচনা জিসি জয়নগর ভায়া রামনগর বাজার সড়কের ১৪ কোটি ৫৯ লাখ ৪৩ হাজার ৪২৬ টাকার ওই কাজে মিলনের খবরদারি আছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মদদেই আনিছ-মিলন জামালগঞ্জে এতদিন বেপরোয়া কর্মকাণ্ড চালিয়েছে অভিযোগ অনেকের। তবে এক্ষেত্রে ভিন্নমত সাবেক উপজেলা প্রকৌশলীর।
এ ব্যাপারে জামালগঞ্জ এলজিইডির সাবেক প্রকৌশলী আব্দুল মালেক মিয়া বলেন, ‘সারা বাংলাদেশেই কাজে অনিয়মের কথা আছে, কিন্তু এলজিইডিতে কোনো অনিয়ম নেই। তারা (আনিছ-মিলন) দীর্ঘসময় এখানে আছেন। এক জায়গায় তিন বছরের বেশি চাকরি করা ঠিক না। এটাই তাদের বড় ভুল। তবে ইচ্ছে করে তারা এখানে থাকেননি। কারণ জামালগঞ্জে কেউ যেতে চায় না।’
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বিগত সরকারের পতন হলে প্রতিকূল পরিবেশ টের পেয়ে অবৈধ কর্মকাণ্ডের হোতা আনিছুর রহমান সদ্য বদলি নিয়ে নিজ জেলা পাবনাতে চলে যান। নিজ দপ্তরে কর্মরত অনেকের কার্যক্ষমতা খর্ব করার পাশাপাশি এলজিইডির ছোট-বড় প্রায় প্রকল্পে একক রাজত্ব ছিল তাদের। দপ্তরের চেয়ারে বসে ধুমপান করাটাও তাদের কাছে জায়েজ ছিল। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এক শ্রেণির ঠিকাদার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যোগসাজশ ও উদাসীনতা তাদেরকে লাগামহীন করে তুলেছে দাবি সূত্রের।
বিগত সময়গুলোতে উপজেলা প্রকৌশলী, সংসদীয় আসন কিংবা উপজেলা পরিষদের চেয়ার যার দখলে গেছে তার কাঁধে সওয়ার হয়েছেন আনিছ-মিলন। বড়কর্তাদের ভাগ-বাটোয়ারায় রাজি করিয়ে অনেক প্রকল্পে অঘোষিত ঠিকাদার, সহঠিকাদার, ভ্রান্ত পদবি ও বেনামি ঠিকাদারি লাইসেন্স ব্যবহার করে তারা হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। অনুগত নয় এমন সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও তাদের কার্যক্ষমতা কেড়ে নিয়ে আনিছ-মিলন দুর্নীতির মাঠে ছিলেন সমানে সমান।
এ ব্যাপারে জামালগঞ্জ খেলাঘর আসরের সভাপতি আলী আক্কাছ মুরাদ বলেন, ‘স্থানীয় পর্যায়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নে এলজিইডির বড় ভূমিকা আছে। কিন্তু সেই দপ্তরটাকে এদের মতো দুর্নীতিবাজ লোকেরা টুটি চেপে ধরেছে। যে কারণে জামালগঞ্জের মানুষ যতটুকু পাওয়ার কথা ততটুকু পায়নি। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রথম সারির এক ঠিকাদার বলেন, ‘আমাকে তারা (আনিছ-মিলন) সহ্য করতে পারত না। কারণ আমার লাইসেন্স তাদেরকে ব্যবহার করতে দেইনি। তাদেরকে যারা (কর্তাব্যক্তি) নিয়ন্ত্রণ করছে তারাই দুর্নীতিবাজ।’ ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমার একটা কাজের অগ্রগতি অনুযায়ী যতটুকু বিল দেওয়ার কথা ততটুকু দেয়নি। আবার তাদের ঘনিষ্ঠ অন্য আরেকজনের কাজ যতটুকু হয়েছে তার চেয়েও বেশি বিল ছাড় দিয়েছে তারা। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’
ভীমখালী ইউপি চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান তালুকদার বলেন, ‘যাদের স্বাক্ষরে এলজিইডির সব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আনিছ-মিলন কীভাবে এত অনিয়ম-দুর্নীতি করতে পারে? অবশ্যই এতে বড় কর্তাব্যক্তিদের যোগসাজশ আছে। বিগত সময়ে এর কিছু কিছু প্রমাণ আমরা পেয়েছি। সবকিছুর তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।’
উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আকবর হোসেন বলেন, ‘জামালগঞ্জে অবশ্যই মজা আছে। তাই তারা (আনিছ প্রায় ৯ বছর, মিলন ১২ বছর) এখানে আছেন। জামালগঞ্জের ছাত্রসমাজ তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ তুলেছে তার সঠিক তদন্ত হওয়া দরকার।’
অফিস সহকারী মোফাজ্জল হোসেন মিলন বলেন, ‘আমি কোন উন্নয়ন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত না। কিছু মানুষ উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমার বিরুদ্ধে এসব কথা বলছেন।’
উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সদ্য বিদায়ী) মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘আমার জানামতে আমি কোনো অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। অনিয়ম হয়ে থাকলে তদন্ত হতে পারে।’
জামালগঞ্জ এলজিইডির প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ইকরামুল হোসেন বলেন, ‘প্রশাসনিক ভবন কাজে সময় বাড়ানো হয়েছে। এখানে একটাই সমস্যা, কাজের গতি স্লো। এছাড়া সব ভালো। সব ঠিকটাক চলছে। তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, সেগুলো আগের ইঞ্জিনিয়ার, ইউএনও সাহেব, চেয়ারম্যান মহোদয়ের আমলের। আমি পাঁচ মাস হয় অতিরিক্ত দায়িত্বে আছি। আমি এ সম্পর্কে কিছুই জানি না।’