রক্তজবার কবিতা, রক্তজবাদের কবিতা

মুস্তাফিজ শফি


অক্টোবর ০৪, ২০২৪
০৩:১৫ অপরাহ্ন


আপডেট : অক্টোবর ০৪, ২০২৪
০৩:১৫ অপরাহ্ন



রক্তজবার কবিতা, রক্তজবাদের কবিতা
মুস্তাফিজ শফির দীর্ঘ কবিতা


যতোদিন বেঁচে আছি আমি রক্তজবার কথা বলবো,
রক্তজবাদের কথা বলবো।
যতোদিন বেঁচে আছি আমি রক্তজবার সঙ্গে কথা বলবো,
রক্তজবাদের সঙ্গে কথা বলবো।

আমার হৃদয়ে ফুটে আছে একেকটি রক্তজবা
আমার চোখের সামনে দুলছে একেকটি রক্তজবার লাল।
রক্তজবা ছাড়া আমি আর কোনো ফুল দেখি না,
রক্তজবার গাঢ় লাল ছাড়া আমি আর কোনো রঙ দেখি না।
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে রক্তজবা ছাড়া
আমি আর কোনো আচ্ছাদন দেখি না।
মাঠে ঘাটে প্রান্তরে শুধু রক্তজবা, রক্তজবা, রক্তজবা
আমার সবুজ স্বপ্নের নাম রক্তজবা,
আমার ভালবাসার নাম রক্তজবা,
আমার একান্ত নীল বাসনার নাম রক্তজবা,
দ্রোহে টানটান প্রতিরোধের নাম রক্তজবা।

সেই কবে ব্রিটিশ ভারতে ফাঁসির রশি লাল করে
ফুটেছিলো ক্ষুদিরাম নামের একটি রক্তজবা,
সূর্যের মতো এখনও প্রজ্বলিত আরেকটি রক্তজবা সূর্যসেন।
আর আন্দামানের অন্ধ প্রকোষ্ঠ দিনের পর দিন
লাল হয়েছিলো আরও আরও কতো রক্তজবায়।
তাকিয়ে দেখি রক্তজবা হয়ে
যুগে যুগে এখনও ফোটে প্রীতিলতা ফুল,
বারবার তারা নাম পাল্টায়
কখনও দিপালী সাহা, কখনও কল্পনা চাকমা,
কখনওবা সেলিনা পারভীন।
বেগম রোকেয়া, জাহানারা ইমাম হয়েও ফোটে রক্তজবা।
ওরা ফুটতেই থাকে, ফুটতেই থাকে,
কখনও হয় না শেষ রক্তজবাদের ঋণ।

যখন সব স্বপ্ন কৃষ্ণগহ্বরে বিলীন হতে হতে
আর্তনাদ করে ওঠে,
অন্ধকারে ডুবতে ডুবতে যখন আলো হাতড়ে ফেরে মানুষ
তখনই শুনি দূরে কোথাও‘জাগো বাহে কুনঠে সবায়’
নূরলদীনের ডাক হয়ে ফোটে রক্তজবা।
কৃষকের বুকের স্বপ্ন হয়ে ফোটে রক্তজবা।
চুন্ডা মুন্ডার তীর হয়ে ফোটে রক্তজবা।
ইলামিত্র, রাশিমনি, কুমুদিনী, মাতঙ্গিনী হয়ে ফোটে রক্তজবা,
অগ্নিকন্যার আগুন হয়ে ফোটে রক্তজবা।
তিতুমীর শরীয়তউল্লাহ হয়ে ফোটে রক্তজবা।
কৈবর্তপাড়ায় ভিম হয়ে ফোটে রক্তজবা।

সিধু কানু হয়ে ফোটে, রজনী কুটুমনি ব্রজনাথ হয়ে ফোটে,
নিরন্নের মুখে একথালা হাসি হয়ে ফোটে রক্তজবা।
যশোদা, ভাদু, মঙ্গল পাণ্ডে আর গোরাচাঁদ হয়ে ফোটে রক্তজবা।
শ্মশানে, গোরস্তানে সমাধিতে ফোটে রক্তজবা,
মসজিদ মন্দির গির্জা প্যাগোডায় ফোটে রক্তজবা,
জায়নামাজ, প্রার্থনা ঘর আর পুজোর বেদিতে ফোটে রক্তজবা।
কোটি মানুষের বুকের গভীরে শিকড় গেড়ে ফোটে রক্তজবা,
বাংলার সবুজ প্রান্তর লালে লাল করে ফোটে রক্তজবা।
প্রতিবাদের নামে, প্রতিরোধের নামে ফোটে রক্তজবা,
সাহসের নামে, নতুন সূর্যোদয়ের নামে ফোটে রক্তজবা।

যতোদিন বেঁচে আছি আমি রক্তজবার কথা বলবো,
রক্তজবাদের কথা বলবো।
যতোদিন বেঁচে আছি আমি রক্তজবার সঙ্গে কথা বলবো,
রক্তজবাদের সঙ্গে কথা বলবো।

আমার ভাইয়ের রক্তে যখন রাজপথ ভেসে যায়,
আমার ভাইয়ের রক্ত যখন তেরশত নদী হয়ে
মেশে বঙ্গোপসাগরে,
চেয়ে চেয়ে দেখি
সালামের নামে ফোটে রক্তজবা, বরকতের নামে,
রফিক শফিক জব্বারের নামে ফোটে রক্তজবা।
আহা রক্তজবা!
মায়ের মুখ উজ্জ্বল করে ফোটে রক্তজবা,
বাবার হাহাকার ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে ফোটে রক্তজবা,
ভাইয়ের খুনির ফাঁসির দাবিতে ফোটে রক্তজবা,
বোনের চোখে আগামী হয়ে ফোটে রক্তজবা।

শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী হয়ে ফোটে রক্তজবা,
ভাসানীর হুংকার হয়ে ফোটে রক্তজবা।
মিছিলের সব মুখ, সব হাত-পা ঘন হয়ে এলে,
জোয়ারের ঢেউয়ের মতো আন্দোলিত হয়ে উঠলে
মতিউরের নামে ফোটে রক্তজবা,
আসাদের শার্ট হয়ে ফোটে রক্তজবা,
মনু মিয়ার প্রতিরোধ হয়ে ফোটে রক্তজবা।
রাজপথে যৌবন বিলিয়ে দেওয়া নাম না জানা
তরুণ তরুণীর নামে ফোটে রক্তজবা।
যারা এসেছিলো একেকটি আলোর সূর্যকে বুকে নিয়ে,
যারা এসেছিলো হাজার স্বপ্নকে বুকে নিয়ে
সেই সব সূর্যের নামে ফোটে রক্তজবা,
সেই সব স্বপ্নের নামে ফোটে রক্তজবা।

যখন উদ্যানের বুকে গর্জে ওঠে বঙ্গোপসাগর,
যখন জয়বাংলায় অগ্নিগর্ভ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া,
যখন সাত কোটি হৃদয়ে গাঁথা একটি শব্দ ‘স্বাধীনতা’
কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না
মার্চের বিকেলে বঙ্গবন্ধুর তর্জনী হয়ে ফোটে রক্তজবা।
সৈয়দ নজরুল আর তাজউদ্দীন হয়ে ফোটে রক্তজবা,
ওসমানী হয়ে ফোটে রক্তজবা,
একেকজন সেক্টর কমান্ডার হয়ে ফোটে রক্তজবা।
পতাকার লালে জ্বলজ্বল করতে থাকা
অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার নামে ফোটে রক্তজবা।
তিরিশ লাখ শহীদের নামে ফোটে রক্তজবা।
জিসি দেব, মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার,
জহির রায়হানের নামে ফোটে রক্তজবা।
বদি, আজাদ, জগৎজ্যোতির নামে ফোটে রক্তজবা।
বুলেটের মুখে বুক পেতে দেওয়া
বাউল কমর উদ্দিনের নামে ফোটে রক্তজবা।
দুই লাখ মা বোনের নামে ফোটে রক্তজবা।
যখন রক্তগঙ্গা বয়ে যায় পুরো বাংলায়
রায়েরবাজারে ফোটে রক্তজবা,
শিয়ালবাড়িতে, মুসলিমবাজারে ফোটে রক্তজবা,
চুকনগর, গল্লামারীতে ফোটে রক্তজবা।
পাহাড়তলীতে, নাথপাড়ায় ফোটে রক্তজবা।
শহীদ মিনারে, স্মৃতিসৌধে ফোটে রক্তজবা।

অকুতোভয় জামিলের নামে ফোটে রক্তজবা।
সিরাজ সিকদারের নামে ফোটে রক্তজবা।
জেলখানার কালো কালো শিকগুলো লাল করে ফোটে রক্তজবা।
তাহেরের নামে, হায়দারের নামে,
খালেদ মোশাররফের নামে ফোটে রক্তজবা।
সেলিম, দেলোয়ার, বসুনিয়ার নামে ফোটে রক্তজবা।
জাফর, জয়নাল, কাঞ্চনের নামে ফোটে রক্তজবা।
তাজুলের নামে, জিহাদের নামে,
নূর হোসেনের নামে ফোটে রক্তজবা।
মিলনের নামে ফোটে রক্তজবা।
গণতন্ত্রের নামে, স্বাধীনতার নামে,
মুক্তির নামে ফোটে রক্তজবা।
মুক্তমত আর সহনশীলতার নামে ফোটে রক্তজবা।
অসাম্প্রদায়িকতার নামে, সমতার নামে,
সম্মানের নামে ফোটে রক্তজবা।
গুচ্ছ গুচ্ছ স্বাধীন ফুল হয়ে মাথা উঁচু করে ফোটে রক্তজবা।

বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে থাকা
আবু সাঈদের নামে ফোটে রক্তজবা।
মুগ্ধর নামে, মুগ্ধদের নামে ফোটে রক্তজবা।
আহনাফ, ইয়ামিন, সৈকতের নামে ফোটে রক্তজবা।
ওরা তো একদিন ফুলই হতে চেয়েছিল, প্রস্ফুটিত ফুল।
সেইসব ফুলকে একত্রিত করে ফোটে রক্তজবা।
কতো সহস্র অপূর্ণ স্বপ্নের নামে ফোটে রক্তজবা।
একখণ্ড স্বপ্নের বাংলাদেশের নামে ফোটে রক্তজবা।

যতোদিন বেঁচে আছি আমি রক্তজবার কথা বলবো,
রক্তজবাদের কথা বলবো।
যতোদিন বেঁচে আছি আমি রক্তজবার সঙ্গে কথা বলবো,
রক্তজবাদের সঙ্গে কথা বলবো।

সবার উপরে মানুষ সত্য
চণ্ডীদাস হয়ে ফোটে রক্তজবা।
লালন, হাছন, করিমের গান হয়ে ফোটে রক্তজবা।
ঢেউয়ের দোলনায় গানগুলো ভেসে বেড়ায়
নদী, খালে, বিলে, হাওরে, সাগরে,
বাতাসের টানে টানে গানগুলো ভেসে বেড়ায়
ভাটিতে, মাটিতে, সমতলে, পাহাড়ে
আর আমাদের কানে বাজতেই থাকে, বাজতেই থাকে
রক্তজবার সুর, আহা রক্তজবার সুর।
উদাস হতে হতে আমরা আবার রক্তজবার দিকে তাকাই,
রক্তজবাদের দিকে তাকাই
রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা হয়ে ফোটে রক্তজবা
নজরুলের বিদ্রোহী হয়ে ফোটে রক্তজবা,
জীবনানন্দের নীলিমার রঙে একাকার হয়ে ফোটে রক্তজবা,
শামসুর রাহমানের বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় হয়ে
সবার হৃদয়ে হৃদয়ে ফোটে রক্তজবা।

রক্তজবা, আমার রক্তজবা, আমাদের রক্তজবা।
রক্তজবারা সহজ মানুষের কথা বলে,
রক্তজবারা সহজ জীবনের কথা বলে।
রক্তজবারা মুক্ত মানুষের কথা বলে,
রক্তজবারা মুক্ত জীবনের কথা বলে।
রক্তজবা মানে আমাদের মুক্তি
রক্তজবা মানে আমাদের স্বাধীনতা।
রক্তজবা মানে অধিকার নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকা।

যতোদিন বেঁচে আছি আমি রক্তজবার কথা বলবো,
রক্তজবাদের কথা বলবো।
যতোদিন বেঁচে আছি আমি রক্তজবার সঙ্গে কথা বলবো,
রক্তজবাদের সঙ্গে কথা বলবো।
আর রক্তজবারা কানে কানে আমায় হার না মানা মন্ত্র শেখাবে।

ঢাকা, ১১.০৯.২৪