নেহার পুরকায়স্থ
মে ১১, ২০২০
১০:৩১ অপরাহ্ন
আপডেট : মে ১২, ২০২০
০৯:৪১ পূর্বাহ্ন
অনন্ত বিজয় দাশ
২০১৫ সালের ১২ মে সিলেট নগরের সুবিদবাজারে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে (৩২) হত্যা করা হয়। তিনি মুক্তমনা ব্লগে লিখতেন। যুক্ত ছিলেন গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গেও।
আজ মঙ্গলবার (১২ মে) অনন্ত হত্যার পাঁচ বছর পূর্ণ হলো। পাঁচ বছর ধরে বিচারের আশায় বুক বেঁধে আছেন অনন্ত বিজয় দাশের পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু বাস্তবে এই হত্যা মামলার অগ্রগতি কতটুকু? বিচারই বা কতদূর? জানতে চাইলে মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী এমাদউল্লাহ শহিদুল ইসলাম মামলার দীর্ঘসূত্রিতার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবু বিচারিক প্রক্রিয়া খুব দ্রুত শেষ হবে বলে তিনি এখনও আশাবাদী।
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগসহ সারাদেশে উত্তাল আন্দোলন চলাকালে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খুন হন শাহবাগ আন্দোলনের কর্মী আহমেদ রাজিব হায়দার। এই হত্যাকাণ্ড ছিল ব্লগে লেখালেখির অপরাধে বাংলাদেশে প্রথম কোনো হত্যাকাণ্ড। এরপর ২০১৫ সালে ঢাকায় খুন হন ব্লগ সাইট মুক্তমনা’র প্রতিষ্ঠাতা মার্কিন প্রবাসী বাংলাদেশি অভিজিৎ রায়। অভিজিৎ রায়কে হত্যার এক মাসেরও কম সময়ের মাথায় ৩০ শে মার্চ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে ঢাকার তেজগাঁও এলাকার একটি সড়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
এই হত্যাকাণ্ডের দেড় মাসের মাথায় ১২ মে সিলেটে খুন হন মুক্তমনা ব্লগ সাইটের অন্যতম লেখক অনন্ত বিজয় দাশ। ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে অনন্ত বিজয় দাশ বনকলাপাড়ার নূরানী আবাসিক এলাকার বাসা থেকে কর্মস্থল জাউয়া বাজারে রওয়ানা হন। সুবিদবাজার পয়েন্টে আসার আগেই তিনি হামলার মুখে পড়েন। চার অস্ত্রধারী চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে তাকে আহত করে। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার আগেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্য হয়। তার মাথায় ও দুই হাতে ধারাল অস্ত্রের আঘাতের ক্ষত ছিল।
সুবিদবাজারের রবীন্দ্র কুমার দাশ ও পীযূষ রানী দাশের দুই মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে অনন্ত ছিলেন সবার ছোট। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্ম বিষয়ে মাস্টার্স করার পর সুনামগঞ্জের জাউয়াবাজারে পূবালী ব্যাংকের ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে যোগ দেন তিনি। অনন্ত বিজয় দাশ সিলেটে গড়ে তোলা গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম উদ্যোক্তা। মুক্তমনা ব্লগে লেখার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন অনলাইনে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও যুক্তিনির্ভর লেখালেখি করতেন। অনন্তের সম্পাদনায় সিলেট থেকে বিজ্ঞান বিষয়ক ছোটকাগজ ‘যুক্তি’ প্রকাশিত হয়। ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞান ও বিপ্লব: লিসেঙ্কো অধ্যায়’, ‘জীববিবর্তন সাধারণ পাঠ’, ‘ডারউইন: একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা’ শিরোনামে তিনটি বইও রয়েছে তার। নিহত হওয়ার আগের দিনও অভিজিৎ ও ওয়াশিকুর হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নিজের ফেইসবুক পাতায় পোস্ট দেন অনন্ত বিজয়।
হত্যাকাণ্ডের দিনই অনন্তের বড় ভাই রত্নেশ্বর দাশ বিমানবন্দর থানায় অজ্ঞাত চারজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালেখির কারণে অনন্তকে ‘উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী’ পরিকল্পিতভাবে খুন করেছে বলে এতে অভিযোগ করা হয়।
মামলাটি পুলিশ থেকে অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তর হয়। সিআইডির পরিদর্শক আরমান আলী তদন্ত করে ২০১৭ সালের ৯ মে আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এতে সন্দেহভাজন আটক ১০ জনকে অব্যাহতির সুপারিশ করে ৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
অভিযুক্ত ৬ জন হলেন, সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার আবুল হোসেন (২৫), খালপাড় তালবাড়ির ফয়সাল আহমদ (২৭), সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের বীরেন্দ্রনগরের (বাগলী) মামুনুর রশীদ (২৫), কানাইঘাটের পূর্ব ফালজুর গ্রামের মান্নান ইয়াইয়া ওরফে মান্নান রাহী ওরফে এবি মান্নান ইয়াইয়া ওরফে ইবনে মঈন (২৪), কানাইঘাটের ফালজুর গ্রামের আবুল খায়ের রশীদ আহমদ (২৫) ও সিলেট নগরের রিকাবীবাজার এলাকায় বসবাসকারী সাফিউর রহমান ফারাবী ওরফে ফারাবী সাফিউর রহমান (৩০)।
এর মধ্যে আবুল, ফয়সাল ও হারুন পলাতক। ফারাবী ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলারও আসামি। অভিযুক্ত আসামিদের মধ্যে মান্নান রাহী আদালতে অনন্ত হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছিলেন। ২০১৭ সালের ২ নভেম্বর মান্নান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে কারা হেফাজতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
গত বছরের ৭ মে সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। কিন্তু সাক্ষীদের অনুপস্থিতির কারণে বারবার পেছানো হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। ফলে এখন পর্যন্ত এই মামলার আশাব্যঞ্জক কোনো অগ্রগতি হয়নি। দীর্ঘদিন সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলার পর সম্প্রতি মামলাটি সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে।
সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর পর গত ২৪ মার্চ এই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় ওইদিন স্বাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি। আদালত সূত্রে জানা গেছে, এই মামলায় মোট ২৯ জন সাক্ষীর মধ্যে ১২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এখনও বাকি আছে ১৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ।
মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে অনন্ত বিজয়ের ভগ্নিপতি আইনজীবী সমর বিজয় সী শেখর সিলেট মিররকে বলেন, ‘এটা ঠিক- এখনও মামলার আশাব্যঞ্জক কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবু আমরা আশাবাদি। আশা করি খুব শিগগির এ মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হবে এবং আমরা ন্যায়বিচার পাব।’ তিনি বলেন, ‘অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে বিচার ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমে যাবে।’
এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে গণজাগরণ মঞ্চ সিলেটের মুখপাত্র দেবাশীষ দেবু সিলেট মিররকে বলেন, ‘নৃশংস এ ঘটনার পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মামলার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতিই হয়নি। উদ্বেগের বিষয় হলো- এর আগে সাক্ষ্য গ্রহণের তিনটি তারিখ পিছিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে রাষ্ট্রপক্ষের অনাগ্রহের কারণেই মামলার অগ্রগতি হচ্ছে না।’ খুনিদের চিহ্নিত করে বিচার করতে না পারলে অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এখন পর্যন্ত মামলার খুব একটা অগ্রগতি না হলেও ন্যায়বিচার নিয়ে আশাবাদি মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী এমাদউল্লাহ শহিদুল ইসলাম। তিনি অনন্ত বিজয়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সিলেট মিররকে বলেন, ‘মামলা দ্রুত শেষ করতে রাষ্ট্রপক্ষ যথেষ্ট আন্তরিক। এ ব্যাপারে পুলিশও আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করছে। আশা করি মামলার অবশিষ্ট সাক্ষীরা আদালতে এসে দ্রুত সাক্ষ্য দেবেন। তাহলেই মামলা দ্রুত নিস্পত্তি করা যাবে।’
মামলাটি বিচারের জন্য সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে পাঠানোয় দ্রুত বিচারের আশা দেখছেন এই আইনজীবী। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি মামলাটি সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে। সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য এই আদালতে একটি দিনও ধার্য্য ছিল। কিন্তু সাধারণ ছুটির কারণে নির্ধারিত দিনে সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। যেহেতু এই আদালতে শুধু সন্ত্রাস দমন আইনের মামলা নিস্পত্তি হবে তাই এখানে মামলার সংখ্যাও হবে কম। তাই আশা করছি এখন খুব দ্রুত অনন্ত বিজয় হত্যা মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন হবে।’
এনপি-০১