উপার্জনে হাওরপাড়ের শিক্ষার্থীরা, বাড়ছে ঝরে পড়ার শঙ্কা

আবির হাসান-মানিক, তাহিরপুর


সেপ্টেম্বর ১১, ২০২০
০১:০৫ পূর্বাহ্ন


আপডেট : সেপ্টেম্বর ১১, ২০২০
০৬:১৬ পূর্বাহ্ন



উপার্জনে হাওরপাড়ের শিক্ষার্থীরা, বাড়ছে ঝরে পড়ার শঙ্কা

প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস ও সাম্প্রতিক পাহাড়ি ঢলে কয়েক দফা বন্যায় বিপর্যস্ত হাওরাঞ্চলের মানুষ। একে তো করোনায় কর্মহীন, তার ওপর তিন দফা বন্যায় বিপর্যস্ত হাওরবাসী এখন জীবন ও জীবিকার সন্ধানে দিশেহারা। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী, শিশু, বৃদ্ধ যে যেভাবে পারছেন অর্থ উপার্জনের পথ খুঁজছেন। একই পথে হাঁটছে হাওরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরাও। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ কয়লা-পাথর কুড়িয়ে, কেউ নৌকা দিয়ে যাত্রী পারাপারের কাজ করে, অনেকে আবার নদীতে বারকি নৌকা দিয়ে বাংলা কয়লা উত্তোলন করে সংকটময় মুহূর্তে বিপর্যস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

করোনার কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কয়েক দফায় বন্ধের সময়সীমা বাড়িয়ে নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার পর এবার চলতি বছরের ৮ম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষাও বাতিল করা হয়েছে। গত পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সারাদেশের মতো হাওরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরাও গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। এমনিতেই হাওরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার তুলনামূলক বেশি, করোনাকালীন অবস্থা পড়ালেখা থেকে তাদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিলো। পাশাপাশি হাওরাঞ্চলে বাল্যবিবাহের হারও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

শহরের স্বচ্ছল ও সচেতন পরিবারের শিক্ষার্থীরা অনলাইন বা টেলিভিশন মাধ্যমে ক্লাস করতে পারলেও হাওরাঞ্চলের অধিকাংশ পরিবারের সেরকম সুযোগ-সুবিধা না থাকায় ও অসচেতন হওয়ার কারণে এ সুবিধার বাইরে রয়েছে অধিকাংশ শিক্ষার্থী। সরকার টেলিভিশনে রেকর্ড করা ক্লাস সম্প্রচার করছে। সেখানেও উপস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। কারণ দুর্গম হাওর অঞ্চলের অনেক পরিবারে নেই কোনো টেলিভিশন বা প্রযুক্তির ছোঁয়া।

এদিকে ৩টি শুল্ক বন্দর ও যাদুকাটা নদীতে শ্রমিকদের কাজ না থাকায় এ সকল পরিবারের শিক্ষার্থীরা স্কুল বন্ধ থাকার সুযোগে বিপর্যস্ত পরিবার বাঁচাতে কেউ সীমান্তের ওপার থেকে ছড়া (নালা) দিয়ে ভেসে আসা কয়লা কুড়িয়ে তা বিক্রি করছে, আবার কেউ মাছ ধরা বা নদীতে ডিঙি নৌকা নিয়ে যাত্রী পারাপারের কাজ ছাড়াও পরিবারের জন্য উপার্জনের উদ্দেশে বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়ছে। সারাদিন কাজ শেষে উপার্জনের প্রায় পুরো টাকাই পরিবারের হাতে তুলে দিচ্ছে এসব শিক্ষার্থী।

সরেজমিনে বড়ছড়া শুল্ক বন্দরে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন খুদে শিক্ষার্থী সীমান্তের ওপার থেকে পানির সঙ্গে ভেসে আসা কয়লা আর পাথর কোদাল ও ঠেলা জালের সাহায্যে ছড়া থেকে কুড়াচ্ছে। জানতে চাইলে পার্শ্ববর্তী একটি বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী নুরেসাবা বলে, 'স্কুল বন্ধ, সারাদিন বাড়িতে বইয়া সময় কাটে না। একা একা পড়তেও মন চায় না। তাই ছড়াতে আইসা কয়লা আর পাথর কুড়াইয়া তা ২৫০-৩০০ টাকা বেইচা মা-বাপের হাতে নিয়া দেই।'

যাদুকাটা নদী তীরবর্তী মানিগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শাহীন মিয়া বলে, 'আমরার স্কুল তো অনেকদিন ধরি বন্ধ, তাই মা-বাপের লগে নদীতে গিয়া কয়লা তুলি। তবে স্কুলো গিয়া পড়তে মন চায়।'

পথিমধ্যে দেখা মেলে মোল্লাপাড়া ও গড়কাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১০-১২ জন শিক্ষার্থীর। তাদের মধ্যে কয়েকজন কালভার্ট থেকে ঝাঁপ দিয়ে নিচের নদীর পানিতে পড়ছিল আর কয়েকজন ছোট জাল দিয়ে পাশের ডোবা থেকে মাছ ধরছিল। সবাইকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, স্কুলে কতদিন ধরে যাওয়া হয় না? সবাই প্রায় এক সঙ্গে বলে উঠল, '১ বছর ধরে স্কুল বন্ধ! বাড়িতে থাকতে থাকতে আর ভাল্লাগে না। কোনোদিন আব্বা-আম্মার কাছে বাড়িতে পড়তে বসি, কোনোদিন আবার পড়তে মন বসে না।'

চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া মিতু নামের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক তৌহিদুল ইসলাম জানান, করোনার কারণে গত ৬ মাস ধরে স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পড়ালেখার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ঠিক, কিন্তু হাওরাঞ্চলের পরিবারগুলোর নানা প্রতিবন্ধকতা, প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতা থাকায় তা আশানুরূপ ফলপ্রসূ হচ্ছে না।

বাদাঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান বলেন, 'করোনাকালীন দীর্ঘদিন ধরে স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পাঠদানে যে ব্যাঘাত ঘটছে তা পুষিয়ে নিতে সরকার টেলিভিশন এবং অনলাইন মাধ্যমে পাঠদানের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। পাশাপাশি আমরা জুম অ্যাপের মাধ্যমে যেসব অভিভাবকদের উপযোগী মোবাইল আছে সেসব শিক্ষার্থীদের পাঠদান দিচ্ছি। এছাড়াও সব শিক্ষার্থীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিয়ে পড়া তৈরি করে দিয়ে আসা হচ্ছে।'

পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাশমির রেজা সিলেট মিররকে বলেন, 'স্কুল বন্ধ থাকার সুযোগে হাওরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা বিভিন্নরকম উপার্জনে ঝুঁকছে, যা শিশুশ্রম। শিশুশ্রম আমাদের কারোরই কাম্য নয়। আর করোনা পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনলাইন এবং টেলিভিশন মাধ্যমে পাঠদান অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু দুর্গম হাওর অঞ্চলে শিক্ষার্থীদের নানা প্রতিকূলতা থাকায় এসব মাধ্যমে পাঠদান আশানুরূপভাবে গ্রহণ করতে পারছে না তারা। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের পরিবারগুলোতে অনেকেরই ৪জি মানের মোবাইল ডিভাইস নেই, আবার অনেকের ঘরে টেলিভিশনও নেই। হাওরাঞ্চলে ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনলাইনে পাঠদানের আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা হলো, উচ্চগতি সম্পন্ন নেটওয়ার্কের অভাব। নেটওয়ার্কের এ সমস্যাটি নিয়ে আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে কথা বলেছি, যেন দুর্গম হাওরাঞ্চলে উচ্চগতিসম্পন্ন (৪জি) নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের পাশাপাশি ইন্টারনেটের বিশেষ প্যাকেজ (স্বল্প মূল্যে) চালু করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার পথ সম্প্রসারিত করা হয়।'

 

এএইচ/আরআর-০৮