বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ
সেপ্টেম্বর ১১, ২০২০
১১:৩৩ অপরাহ্ন
আপডেট : সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২০
০৩:২১ পূর্বাহ্ন
জং ধরেছে শতবছরের ঐতিহ্যে। মরচেপড়া বিবর্ণতায় রং হারিয়েছে চালের টিনগুলো। ঘরের বেষ্টনিতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে জীর্ণতার ছাপ। ভেতরে বাসা বেঁধেছে পতঙ্গরা। প্রাচীনতার প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নির্জীব স্থাপনার কাছ ঘেঁষলে অনুভব করা যায় রক্ষার নীরব আকুতি। সেবা আর ঐতিহ্যে গর্বিত স্থাপনাটি একদা বহু মানুষের রোগমুক্তিতে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করলেও বর্তমানে এটি নিজেই রোগাক্রান্ত হয়ে বেঁচে থাকার আকুতি জানাচ্ছে।
বার বার নিজেকে রক্ষার নিশ্চুপ দাবি জানিয়ে ব্যর্থপ্রায় সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনা বাজারের শহীদ মিনার সংলগ্ন পুরোনো হাসপাতালটি। একসময়কার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা উপজেলার একমাত্র এই চিকিৎসাকেন্দ্রটি বর্তমানে দূষণ ও দখলের শিকার হয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় পতিত হয়েছে।
বিপন্ন শতবর্ষী এ হাসপাতালটিতে দেশবরেণ্য রাজনীতিক প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জন্ম হয়েছে- এমন জনশ্রুতি ধারণ করে সর্বদা মৃত্যুর প্রহর গুনছে। সুরমায় পৃথক হওয়া উপজেলার প্রায় অর্ধেকে বিস্তৃত সাচনা বাজার অংশের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে পুরোনো জরাজীর্ণ এ হাসপাতালটিকে সংস্কার করে অন্তত ১০ শয্যাবিশিষ্ট দাতব্য চিকিৎসালয় করার জোর দাবি জানিয়ে আসছেন এলাকার সর্বস্তরের মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার কামলাবাজ মৌজার জেএল নম্বর-১৮, ৭৪৮৬ নম্বর দাগে ৪৬ শতক ভূমির উপর স্থাপিত পুরাতন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি বার বার অবৈধ দখলদারদের কবলে পড়েছে। অপারেশন ক্লিন হার্টের সময় সেটি অবৈধ দখলমুক্ত করে সীমানা প্রাচীর দেওয়া হয়েছিল। তারপরও দখল ও দূষণমুক্ত হতে পারছে না শতবছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এ হাসপাতালটি। বর্তমানে একটি চক্র হাসপাতালের এ জায়গাটি বন্দোবস্ত নিয়ে দখলের পাঁয়তারা চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। এ অপতৎপরতা প্রতিরোধ করে সেখানে পুনরায় হাসপাতাল নির্মাণ করা হোক- এ দাবি সকলের।
এলাকার অশীতিপর কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাচনা বাজারের পুরোনো এই হাসপাতালটি ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পুরো উপজেলায় তখন এই একটিমাত্র চিকিৎসালয় ছিল। তৎকালীন সময়ে জেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা দুরূহ থাকায় মানুষের রোগমুক্তির অন্যতম ভরসাস্থল ছিল সেটি। সেখানে একজন এলএমএএফ ডাক্তার ও দুইজন কম্পাউন্ডারসহ ৩ জন তদানীন্তন চিকিৎসাসেবা পরিচালনা করে এসেছেন। স্বাধীনতার পূর্ব ও পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে ডা. শামসুল ইসলাম চৌধুরী (পাগলা ডাক্তার হিসেবে খ্যাত), ডা. মতিলাল সিনহা, ডা. গ্রীষ্পতি নন্দন চৌধুরী, ডা. রইছ উদ্দিন, ডা. আহমদ হোসেন ও ডা. আকমল হোসেন এ হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে কম্পাউন্ডার হিসেবে গোপেন্দ্র কুমার আচার্য্য, কার্তিক দাস ও ক্ষীরদ মোহন রায়ের নাম তথ্যানুসন্ধানে উঠে এসেছে। এর আগে আরও অনেকে এ হাসপাতালে কর্মরত থাকলেও সুনির্দিষ্টভাবে কারও নাম-পরিচয় জানা যায়নি।
হাসপাতালের তৎকালীন কম্পাউন্ডার প্রয়াত গোপেন্দ্র কুমার আচার্য্য'র ছেলে সমরেন্দ্র আচার্য্য শম্ভুর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার বাবা ১৯৪৯ সালে সাচনা বাজারের এই হাসপাতালটিতে যোগদান করেছিলেন। বাবার রেখে যাওয়া পুরাতন নথি ঘাঁটতে গিয়ে তিনি যোগদানের বিষয়টি নিশ্চিত হন। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে সুরমার অপর পাড়ে জামালগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার পর সেটি সেখানে স্থানান্তরিত হয় এবং এর কয়েকবছর পর তার বাবা অবসরে যান। গোপেন্দ্র আচার্য্য সেখানে কর্মরত থাকাবস্থায় সর্বশেষ ৪ জনের একটি স্টাফ ছিল বলে তিনি জানিয়েছেন। যার মধ্যে দক্ষিণ কামলাবাজ গ্রামের সুরুজ মিয়া পিয়নের চাকরি করতেন।
সাচনা চৌধুরী বাড়ির অমল কান্তি ঘোষ চৌধুরী (৮৮) ও একই গ্রামের মন্তোষ সরকার (৭৬) বলেন, ‘এ হাসপাতালটি ছাড়া একসময় এখানে দ্বিতীয় কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র ছিল না। অনেক জায়গার ডাক্তার এখানে চাকরি করে গেছেন। কিন্তু বর্তমানে ভাঙাচোরা দুই-তিনটি ঘর ছাড়া সেখানে পাওয়ার কিছু নেই। রাতে যদি কোনো গর্ভবতীর প্রসবজনিত সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে নদী পার হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়া সম্ভব নয়। এখানকার সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবার কথা চিন্তা করে ভঙ্গুর এই হাসপাতালটিকে জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করে চালু করা দরকার।’
সাচনা গ্রামের ৮৪ বছর বয়সী মো. আব্দুল কুদ্দুছ বলেন, ‘এ হাসপাতালে খুব ভালো ডাক্তার ছিল এবং চিকিৎসার মানও ছিল খুব ভালো। আমি নিজেও এখানে চিকিৎসা করিয়েছি। তখন শহরে গিয়ে চিকিৎসা করানোর কোনো সুযোগ ছিল না। পায়ে হেঁটে সুনামগঞ্জে যেতে সময় লাগত প্রায় ৫ থেকে ৬ ঘন্টা। তাই অত্র এলাকায় চিকিৎসার মূল কেন্দ্র হিসেবে হাসপাতালটির গুরুত্ব ছিল আলাদা। যখন জামালগঞ্জে হাসপাতাল হলো, তখন থেকে এ হাসপাতালটি অচল হয়ে পড়ে। এখন এই পাড়ের মানুষের জরুরি চিকিৎসাসেবার কথা চিন্তা করে হাসপাতালটি চালু করা প্রয়োজন।’
সাচনা বাজার ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান রেজাউল করিম শামীম বলেন, ‘উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের প্রায় ৪৫ ভাগ মানুষ সুরমার এই পাড়ের বাসিন্দা। কিন্তু এখানে জরুরি কোনো চিকিৎসার সুযোগ নেই। একসময় সাচনা বাজারের এই পুরাতন হাসপাতালটিই ছিল চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল। বর্তমানে প্রাচীন হাসপাতালটি জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। শুনেছি ঐতিহ্যবাহী পুরাতন এ হাসপাতালের সরকারি জায়গাটুকু খাস খতিয়ানে নিয়ে বন্দোবস্ত দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। সেটা বন্ধ হওয়া উচিত। এখানকার মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে দ্রুত হাসপাতাল প্রতিস্থাপন করে সরকারের স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার দাবি জানাই।’
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মঈন উদ্দিন আলমগীর বলেন, ‘এমপি মহোদয় আমাদের মৌখিকভাবে বলেছেন এখানে ১০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল হবে। আমরাও চাই চিকিৎসা সুবিধার্থে এখানে একটি হাসপাতাল হোক। সে মোতাবেক প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা পাঠাবো। তার আগে সীমিত আকারে এখানে বহির্বিভাগ চালুর পরিকল্পনা আছে।’
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বলেন, ‘এখানে ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু হাসপাতাল করার পরিকল্পনা প্রকল্পভুক্ত হয়েছে। প্রক্রিয়াগত কাজ শেষে এর অবকাঠামোগত কাজ শুরু হবে।’
বিআর/আরআর-০২