হাওরাঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবায় বইছে সুবাতাস

আবির হাসান-মানিক, তাহিরপুর


সেপ্টেম্বর ২০, ২০২০
০১:১২ পূর্বাহ্ন


আপডেট : সেপ্টেম্বর ২০, ২০২০
০১:১২ পূর্বাহ্ন



হাওরাঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবায় বইছে সুবাতাস

ঝাড়ফুঁক, তাবিজ, কবিরাজি ইত্যাদি অপচিকিৎসা যেখানে একসময় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেখানে আজ স্বাস্থ্যসেবায় পিছিয়ে পড়া জনপদ দুর্গম হাওরাঞ্চল সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো। একটা সময় ছিল যখন এ অঞ্চলের লোকজনকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা জেলা সদরে যেতে হতো। কিন্তু এখন দিন বদলেছে। এখন হাওরবেষ্টিত এ অঞ্চলের লোকজন ঘরের কাছে কোনো ধরণের ভোগান্তি ছাড়াই বিনামূল্যে ওষুধ আর সেবা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন।

সারাদেশের ন্যায় তাহিরপুরে দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত, অসহায় মা ও শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং বয়োবৃদ্ধ জনগণের স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ২০টি (২টি উদ্বোধনের অপেক্ষায়) কমিউনিটি ক্লিনিক যেন স্বাস্থ্যসেবার অন্যতম ভরসাস্থলে পরিণত হয়েছে। এ যেন দুর্গম হাওরাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবায় আশার আলো এবং আস্থা ও ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছে।

জানা যায়, বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সপ্তাহে ৬ দিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত অন্তঃসত্ত্বা নারীর প্রতিষেধক টিকাদান এবং নবজাতকের সেবাসহ, যক্ষ্মারোগের প্রতিষেধক টিকা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, পোলিও, ধনুষ্টংকার, হাম, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া, কুষ্ঠ, কালাজ্বর, ডায়রিয়াসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং সেগুলোর সীমিত পরিসরে চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। 

এছাড়াও জ্বর, ব্যথা, কাটা, পোড়া, হাঁপানি, চর্মরোগ, কৃমি এবং চোখ, দাঁত ও কানের সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে লক্ষণভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসাও প্রদান করা হচ্ছে। তাছাড়া ক্লিনিকগুলোতে অস্থায়ী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সংক্রান্ত বিভিন্ন উপকরণসহ বর্তমানে বিনামূল্যে ৩০ ধরণের ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে ক্লিনিক থেকে। বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় এবং সেখানে বিনামূল্যে সাধারণ রোগের ওষুধ পাওয়া যায় বলে হাওর জনপদের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে দিন দিন কমিউনিটি ক্লিনিকের কদর বেড়ে চলেছে, সঙ্গে বাড়ছে সেবাগ্রহীতার সংখ্যাও।

সরেজমিনে তাহিরপুরের জৈতাপুর কমিউনিটি ক্লিনিক ঘুরে দেখা যায়, সকাল থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা নিচ্ছেন বেশ কয়েকজন নারী। কথা হয় তাদের সঙ্গে। জামবাগ গ্রামের বিলকিছ বেগম (৪৩) বলেন, 'আমার মেয়ের প্রসব বেদনা শুরু হলে তাড়াতাড়ি এখানে নিয়ে আসি। পরে ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় সুস্থভাবেই ডেলিভারি সম্পন্ন হয়। তারা আমাকে ১ হাজার টাকা আর সঙ্গে ওষুধও দিয়েছে।'

গড়কাটি গ্রামের বাসিন্দা সাবিকুন নাহার (২৮) বলেন, 'আমরা গরিব মানুষ, টাকা-পয়সা কম। অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। এখন সর্দি, কাশি, জ্বর, ডায়রিয়া হলে এখানে এসেই সেবা পাচ্ছি। এতে করে আমরার মতো গরিব মানুষের অনেক উপকার হয়ছে।'

সেবা নিতে আসা জামবাগ গ্রামের বৃদ্ধা আমেনা খাতুন (৭০) বলেন, 'আমাদের সময় তো এমন সুযোগ-সুবিধা ছিল না, এখন জীবনের শেষ সময়ে এসে বাড়ির কাছে এমন স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে গ্রামের সবাই খুশি। সরকার আমাদের জন্য অনেক উপকারী একটা কাজ করেছে।'

রোগীকে পরামর্শ প্রদানরত অবস্থায় জৈতাপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) সামাদুল হোসেন বলেন, 'শুরুর দিকে লোকজন কম আসত। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে। সকাল থেকেই সেবা নিতে লোকজন ভীড় করছেন। জটিল কোনো সমস্যা মনে হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বা জেলা শহরে যাওয়ার পরামর্শ দেই। তবে বর্তমানে প্রাথমিক অনেক সেবাই আমরা এখান থেকে দিতে পারছি। করোনা পরিস্থিতিতেও আমরা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সহিত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। এলাকার সচেতন জনগণও নানা উপায়ে আমাদের সহযোগিতা করছেন। ক্লিনিকে একটি দানবাক্স রয়েছে। সেবাগ্রহীতারা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী তাতে দান করেন। আর এ টাকায় ক্লিনিকের প্রয়োজনীয় সংস্কার, ছোটখাটো কাজ করাসহ অসহায় দরিদ্র রোগীদের সহায়তা করা হয়।' 

কামারকান্দি কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) আব্দুল আওয়াল বলেন, 'এখন দিন বদলেছে। সেবা নিতে আসা লোকজনের আস্থা ও ভরসার জায়গাতে পরিণত হচ্ছে ক্লিনিকগুলো। করোনাকালীন সময়ে ঝুঁকি নিয়েই আমরা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। তবে ক্লিনিকগুলোতে ওষুধের পরিমাণ বাড়াতে পারলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর লোকজন আরও উপকৃত হতেন। করোনা, বন্যা সকল পরিস্থিতিতেই আমরা নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা প্রদান করে যাচ্ছি। আমাদের বেতন-ভাতাসহ সরকারি আনুষাঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা বাস্তবায়ন যেন দ্রুত হয়, কর্তৃপক্ষের নিকট এটাই আমাদের চাওয়া।'

জৈতাপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও বাদাঘাট ইউনিয়নের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হাসনারা খাতুন বলেন, 'স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা ও ভরসা দিন দিন বাড়ছে। আমি ক্লিনিকে ১টি সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আর এখানে নিয়োজিত স্বাস্থ্য সহকারীরা তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।'

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. ইকবাল হোসেন সিলেট মিররকে বলেন, 'হাওরবেষ্টিত এ অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবায় কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। করোনা পরিস্থিতিতে হেলথ প্রোভাইডারগণ ঝুঁকি নিয়েই স্বাস্থ্যসেবা প্রদান অব্যাহত রেখেছে। গত বছর দুয়েক ধরে ক্লিনিকগুলোতে প্রসূতি মায়েদের গর্ভকালীন নিরাপদ সেবা অনেকগুণ বেড়েছে। বলা যায়, গর্ভকালীন সেবা প্রদানে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো একে অপরের সংগে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য অবশ্যই ভালো দিক।'

তিনি বলেন, 'সাম্প্রতিক কয়েক দফা বন্যায় বেশ কয়েকটি ক্লিনিকের অবকাঠামোগত সমস্যা হয়েছে। এগুলো সংস্কারের জন্য চাহিদা পাঠানো হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর পরিসেবা আরও বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবাসমূহের প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধির লক্ষ্যে কমিউনিটি মাল্টিপারপাস হেলথ ভলান্টিয়ার (স্বেচ্ছাসেবক) নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।'

 

এএইচ/আরআর-০৬