অনলাইন গেমে আসক্ত শিশু-কিশোর, উদ্বিগ্ন অভিভাবক

শিপার আহমেদ, বিয়ানীবাজার


ডিসেম্বর ০৪, ২০২০
১১:৫২ অপরাহ্ন


আপডেট : ডিসেম্বর ০৪, ২০২০
১১:৫২ অপরাহ্ন



অনলাইন গেমে আসক্ত শিশু-কিশোর, উদ্বিগ্ন অভিভাবক

মাঠে গিয়ে ধুলো-কাদা মাখা হয় না আর এখন। ঘেমে-নেয়ে বিকেলে খেলা শেষে বাড়ি ফেরার চিরায়ত দৃশ্যটা আজকাল যেন হারিয়ে যাচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় খেলার জায়গার অভাব, পড়ার চাপ, বাইরে গেলে খারাপ হওয়ার ভয়- কতই না অভিযোগ অভিভাবকদের! তাই বাইরে যাওয়ার বদলে অভিভাবকরা বিনোদনের নামে প্রযুক্তি তুলে দিচ্ছেন ছোট ছেলে-মেয়েদের হাতে, যার ক্ষতির পরিমাণ তাদের ধারণার বাইরে। বিশেষ করে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার চিত্র ক্রমেই মারাত্মক হয়ে উঠছে।

সাম্প্রতিক বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে স্কুল-কলেজসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। তাই নেই কোনো পড়াশোনার চাপ। অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে সময় পার করছে ঘরে বসে। আর সময় কাটাতে অধিকাংশ শিশু-কিশোর বেছে নিয়েছে অনলাইন গেম। এসব অনলাইন গেমের মধ্যে অন্যতম পাবজি এবং ফ্রি ফায়ার। এই অনলাইন গেমগুলোর ব্যবহার দিন দিন কেবল বেড়েই চলেছে। শিশু থেকে কিশোর দিন থেকে রাত সারাক্ষণই এই গেমে মগ্ন। দিন দিন এই গেম মাদকের নেশার মতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। আর এর মাধ্যমে ঘরের চার দেওয়ালের ভেতরেই আটকা পড়ছে শিশুদের বর্ণিল শৈশব। তারা খেলাধুলার আনন্দ খুঁজে ফিরছে মাউসের বাটন টিপে, কম্পিউটারের পর্দায় গেমস খেলে কিংবা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখে। অনেক সময় তাদের এ আকর্ষণ চলে যাচ্ছে আসক্তির পর্যায়ে। ধীরে ধীরে তারা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে কম্পিউটার, মোবাইল, ট্যাব গেমসের ওপর। এসব ভিডিও গেমস শিশু-কিশোরদের প্রকৃত শৈশব-কৈশোর কেড়ে নিচ্ছে।

পশ্চিমা বিশ্বের মতো আমাদের অনেক পরিবারে বাবা-মা দু'জনই কর্মব্যস্ত জীবন কাটাচ্ছেন। উভয়েই ছুটছেন ‘ক্যারিয়ার ও সফলতা’ নামক সোনার হরিণের পেছনে। আবার গ্রামীণ এলাকায় বাবা-মায়ের কর্ম ও পারিবারিক ব্যস্ততায় একাকীত্বে থাকতে হচ্ছে সন্তানদের। সন্তান বড় হচ্ছে প্রায় একা একা। অনেক মা শিশুকে খাবার খাওয়াতে, তার কান্না থামাতে টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ও ভিডিও গেমসের অভ্যাস করাচ্ছেন।

সরেজমিনে বিয়ানীবাজার পৌরশহরসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সকাল-সন্ধ্যা নিজের বাড়ি, খেলার মাঠ এমনকি রাস্তার পাশে মোবাইল হাতে নিয়ে হিন্দি ও বাংলা ভাষায় কথা বলায় ব্যস্ত শিশু-কিশোররা। এর মধ্যে ‘মার মার’ এই কথাগুলো তাদের মুখে সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে। অনেককে আবার অবলীলায় হিন্দি ভাষায় কথা বলতেও দেখা গেছে।

উপজেলার তিলপাড়ায় ইউনিয়নের একটি গ্রামে গিয়ে পাবজি খেলে এমন কয়েকজন শিশু-কিশোরের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানায়, এই গেম একা ও গ্রুপে খেলা যায়। মাঠে অনেকগুলো টিম ছাড়া হয়। সবাইকে মেরে যে বেঁচে থাকবে সেই জয়ী হয়। বেশিরভাগই গ্রুপে খেলতে পছন্দ করে। গ্রুপ করে খেলতে গেলে ওভারফোনে ইনস্ট্রাকশন দিতে হয়। মানে একা বসে বসে কথা বলার মতো। আবার খেলার সময় যেন কেউ বিরক্ত না করে সেজন্য একা থাকতে হয়। মানে অন্য কোথাও মনোযোগ দেওয়া যাবে না।

মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা এবং হাতের নাগালের মধ্যে থাকা ইন্টারনেটের কারণেই এসব গেমের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। বর্তমানে এসব গেমে অত্যধিক আসক্ত হয়ে পড়ছে শিশু থেকে শুরু করে কিশোর এবং তরুণরাও। আর এ নিয়ে উদ্বিগ্ন অনেক অভিভাবক।

আবুল কালাম নামের এক অভিভাবক বলেন, 'এখন স্কুল বন্ধ থাকায় অনলাইনে ক্লাস চলছে। বাড়িতে বসে সেই ক্লাসে অংশ নেওয়ার জন্যই শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিয়েছি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। আমার সন্তানরা মোবাইলে কি একটা গেমস আছে সেটা নিয়েই সারাদিন মগ্ন থাকে। পড়াশোনার কথা আর কি বলব, এই গেমস না খেললে তারা না কি ভাত খেতে পারে না, ঘুমাতে পারে না! এমন পরিস্থিতিতে আমি খুবই উদ্বিগ্ন। এসব গেমস আমাদের দেশে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য আমি সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।'

এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বিয়ানীবাজার শাখার সভাপতি এ্যাডভোকেট আমান উদ্দিন বলেন, 'এসব গেমসে আসক্তির কারণে শিশু-কিশোররা পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। খেলার একপর্যায়ে এসে তারা ভায়োলেন্ট (আক্রমণাত্মক) হয়ে যেতে পারে। এমনকি এটি আরেক আলোচিত গেম ব্লু হোয়েল এর মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। লেখাপড়ায় ফাঁকি দিয়ে সারারাত এই গেম খেলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরণের আসক্তি তৈরি হয়েছে। পড়ালেখায় অনেকেরই মনোযোগ কমে গেছে। গেমটি খেলতে না পারলেই মানসিক যাতনা তৈরি হয়। এ কারণে এসব অনলাইন গেম নিয়ন্ত্রণে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত।'

 

এসএ/আরআর-০২