শুয়াইব হাসান
ডিসেম্বর ১৪, ২০২০
০৬:০০ পূর্বাহ্ন
আপডেট : ডিসেম্বর ১৪, ২০২০
০৬:০০ পূর্বাহ্ন
সিলেট ও বরিশাল বিভাগে কৃষি জমির পরিমাণ প্রায় সমান। কিন্তু অনাবাদি জমির পরিমাণ সিলেটে প্রায় আড়াইগুণ বেশি। শুধু তাই নয়-সারা দেশের মধ্যে অনাবাদি জমির হিসাবে সিলেট শীর্ষে রয়েছে। পতিত এসব জমি চাষের আওতায় আনার জন্য কৃষি বিভাগ নানা উদ্যোগ নিলেও অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষি কাজের প্রতি মানুষের অনাগ্রহ এমন নানা কারণে কৃষি জমির পরিমাণ যেমন কমছে, বাড়ছে আবাদযোগ্য পতিত জমির সংখ্যা।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৭-১৮ কৃষি বর্ষপঞ্জিতে দেখা গেছে, সিলেটে বছরে পতিত থাকে ২ লাখ ৫৪ হাজার একর জমি। যেখানে বরিশালে ৬২ হাজার একর এবং রাজশাহীতে মাত্র ২১ হাজার একর জমি অনাবাদি থাকে।
সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট অঞ্চলে নিট ফসলি জমির পরিমাণ ৭ লাখ ৮৩ হাজার ৪৩৮ হেক্টর। এর মধ্যে সিলেট জেলায় ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৮ হেক্টর, মৌলভীবাজারে ১ লাখ ২১ হাজার ১৫০ হেক্টর, হবিগঞ্জে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৯০০ হেক্টর ও সুনামগঞ্জ জেলায় ২ লাখ ৭৮ হাজার ৩৪০ হেক্টর।
এ অঞ্চলে রবি মৌসুমে ১ লাখ ৬৪ হাজার হেক্টর, খরিপ-১ মৌসুমে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৭৭৪ হেক্টর এবং খরিপ-২ মৌসুমে প্রায় ৪৩ হাজার ৬৫৬ হেক্টর জমি পতিত থাকে। রবি মৌসুমে সিলেট জেলায় ৬৩ হাজার ৮০৩ হেক্টর, মৌলভীবাজারে ৫০ হাজার ৩৭৬ হেক্টর, হবিগঞ্জে ২৮ হাজার ২০২ হেক্টর এবং সুনামগঞ্জে ২১ হাজার ৭৮৩ হেক্টর।
সিলেটের অনাবাদি জমি আবাদের আওতায় আনার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কৃষি কোর কমিটি গঠন করেন তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার জামাল উদ্দিন আহমদ। জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও কোর কমিটি গঠন করা হয়। সে সময় সার্কিট হাউজে এক সংবাদ সম্মেলনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, সিলেটের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ কৃষ্ণ চন্দ্র হোড় জানিয়েছিলেন, সিলেট বিভাগে মোট ৭ লাখ ৮৯ হাজার ১০৩ হেক্টর ফসলি জমি রয়েছে। এসব জমির মধ্যে রবি মৌসুমে পতিত থাকে ১ লাখ ৬৪ হাজার হেক্টর, খরিপ-১ মৌসুমে জমি পতিত থাকে ১ লাখ ৮১ হাজার ৭২৫ হেক্টর, খরিপ-২ মৌসুমে ৭১ হাজার ৫০১ হেক্টর জমি পতিত থাকে।
প্রথমে ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে ফসল উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাইলট উদ্যোগে আশানুরূপ সাড়া পাওয়ায় পরবর্তীতে লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়। কিন্তু, তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার ও আঞ্চলিক কৃষি কর্মকর্তা বদলি হওয়ার পর এ উদ্যোগে ভাটা পড়ে।
প্রথম বছর বিভাগের ৩৯টি ইউনিয়নে ২৫ হাজার ১৯৬ হেক্টর জমি চাষের আওতায় আনা হয়। উদ্যোগটি প্রথমেই সফলতা পায় ৬৯ শতাংশ। ২০১৬ সালের খরিপ-১ মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার অগ্রগতি নেমে আসে ৪৯ শতাংশ। পরবর্তী রবি মৌসুমে ১১৫টি ইউনিয়নে এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু অর্জন পর্যায়ক্রমে ৩৪ ও ১৬ শতাংশে নেমে আসে।
জমি অনাবাদি থাকার অন্যতম কারণ হিসেবে প্রবাসীদের জমি চাষাবাদে অনীহাই মূল কারণ বলে মনে করেন কৃষি কর্মকর্তারা। একইসঙ্গে সেচ সুবিধার অভাব ও বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি অন্যতম। সিলেটের বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, বিশ্বনাথ, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে ও মৌলভীবাজারের কিছু এলাকায় প্রবাসীর সংখ্যা বেশি। এ অঞ্চলে সারাবছরই হাজার হাজার হেক্টর জমি পতিত থাকে।
বালাগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমন মিয়া জানান, তার উপজেলায় ১৪ হাজার হেক্টর জমি বছরে অনাবাদি থাকে। যা নীট ফসলি জমির প্রায় অর্ধেক। এসব জমি অনাবাদি থাকার পেছনে তিনি কৃষকদের অনাগ্রহ ও প্রবাসীদের মালিকানায় থাকা জমি বর্গা না দেওয়ার প্রবণতাকে দায়ী করেন।
ওসমানীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘প্রবাসীরা জমি ক্রয় ও কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বিলাসবহুল বাড়ি তৈরিতে প্রতিযোগিতা করেন। চাষাবাদ কিংবা লাভজনক বিনিয়োগে তাদের আগ্রহ নেই। তাদের জমি লিজের মাধ্যমে চাষাবাদের আওতায় আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার আদমপুর গ্রামের মোশাহিদ খান ইউরোপ প্রবাসী। চল্লিশ বছর ধরে যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন। দৈনিক সিলেট মিরর-এর সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, তার অন্তত ৬০ বিঘা জমি সারাবছরই অনাবাদি থাকে। বর্গা দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যার কথাও তুলে ধরেন তিনি।
মোশাহিদ খান বলেন, ‘কৃষকের কাছে জমি বর্গা দেওয়ার পর এক পর্যায়ে চাষি জমির মালিকানা দাবি করে। ঠিকমতো ফসলও পাওয়া যায় না। তাই জমির নিরাপত্তা জটিলতা এড়াতে পতিত রাখাই যুক্তিযুক্ত মনে করি।’
অবশ্য, কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, জটিলতা এড়াতে প্রবাসীদের নানা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। লিজ নিয়ে ইতোমধ্যে বেশ কিছু জমি আবাদের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। এতে জমি আবাদের আওতায় আসছে, জটিলতাও এড়ানো যাচ্ছে। অনাবাদি জমি আবাদের আওতায় আনতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ, উৎসাহ ও প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অনাবাদি থাকার পেছনে এসব কারণ ছাড়াও সেচের অপ্রতুলতা, আকষ্মিক বন্যা, শ্রমিক সংকট, হাওরে প্রযুক্তির ব্যবহার কম এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব, ভ‚-গর্ভস্থ পানির স্থর নেমে যাওয়া এবং ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়াকে- চিহ্নিত করেছে।
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের প্রায় ১২ হাজার ৮০০ হেক্টর জমি সারাবছরই অনাবাদি থাকে। বোরো মৌসুমে সেচের অভাবে এসব জমি আবাদ করা সম্ভব হয়নি বলে জানালেন উপজেলার নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুল হাসান আমিরুল। যদিও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুলতান মিয়া গতকাল সিলেট মিররকে জানিয়েছেন, গোয়াইনঘাটে এ বছর সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে ৫০ হেক্টর পতিত জমি আবাদের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রণজিৎ কুমার দেব সিলেট মিররকে জানিয়েছেন, সিলেট বিভাগে সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে গত চার বছরে ২১ হাজার হেক্টর জমি আবাদের আওতায় আনা হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ অনাবাদি জমি ছিল ১৬ হাজার হেক্টর। তিনি জানান, আরও ৬০ হাজার হেক্টর জমি আবাদের আওতায় আনতে একটি প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে।
গত বছর রবি মৌসুমে ওসমানীনগর উপজেলার একটি গ্রামের পাশে প্রায় ৬৫ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেন একজন কৃষক। যে জমিতে বিগত ৪০ বছরে একবারও চাষ হয়নি। তার সাফল্য দেখে গ্রামের আরও অনেকে ভুট্টা চাষে উৎসাহী হয়েছেন।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিকল্পিতভাবে সিলেটের জমির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে এ অঞ্চলে কৃষি বিপ্লব সম্ভব। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম সিলেট মিররকে বলেন, ‘সিলেট অঞ্চলে কৃষি জমি আবাদের আওতায় আনতে কৃষিবান্ধব সহজ নীতি অবলম্বন করা দরকার। মাত্র কয়েক হাজার টাকা খেলাপির কারণে কৃষককে ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিলে কৃষকরা নিরুৎসাহিত হবে। এছাড়া কৃষি জমি অনাবাদি রাখা যাতে অপরাধের পর্যায়ে পড়ে সেই নীতি প্রয়োগ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সমস্যা চিহ্নিত করে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষিতে মানুষের আগ্রহ বাড়াতে হবে। অনাবাদি জমি আবাদ হলে খাদ্য উৎপাদন বাড়বে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) সিলেট আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপপরিচালক (তথ্য প্রদানকারি কর্মকর্তা) কৃষিবিদ মজুমদার মো. ইলিয়াছ জানান, কৃষি বিভাগ কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে অনাবাদি জমি আবাদের আওতায় আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক হারে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সিলেটের অনাবাদি জমিতে উৎপাদনশীল ও লাভজনক শস্য আবাদের পরিসংখ্যান এখন উর্ধ্বমুখী।
বিএ-০১