সিলেট অঞ্চলে শস্যের নিবিড়তা সবচেয়ে কম

শুয়াইব হাসান


ডিসেম্বর ২৮, ২০২০
০৫:০৩ পূর্বাহ্ন


আপডেট : ডিসেম্বর ২৮, ২০২০
০৫:০৩ পূর্বাহ্ন



সিলেট অঞ্চলে শস্যের নিবিড়তা সবচেয়ে কম
৭৪ কোটি খরচ করে পাঁচ বছরে ৬ শতাংশ বৃদ্ধি

সারাদেশের মধ্যে সিলেট অঞ্চলে শস্যের নিবিড়তা সবচেয়ে কম। এ অবস্থার উত্তরণে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি বিভাগ। একটি প্রকল্পও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু, অগ্রগতি বলতে তেমন কিছু নেই। তবে, কৃষি কর্মকর্তাদের দাবি, ধীরে ধীরে সিলেটের শস্যের নিবিড়তা বাড়ছে। 

সিলেট অঞ্চলের কৃষিতে গতিশীলতা আনতে ২০১৫ সালে ৭৪ কোটি ৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘সিলেট অঞ্চলে শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। শেষ হয় ২০১৯ সালের জুন মাসে। এই প্রকল্পের অগ্রগতি কতটুকু? তার সুনির্দিষ্ট জবাব মেলেনি। তবে, কৃষি বিভাগ বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়নসহ এই পাঁচ বছরের সার্বিক চেষ্টায় শস্যের নিবিড়তা বেড়েছে ৬ শতাংশ। 

২০১৫ সালে সিলেটে শস্যের নিবিড়তা ছিল ১৬৩ শতাংশ। বর্তমানে ১৬৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। জাতীয় হিসেব অনুযায়ী, সারাদেশে শস্যের নিবিড়তা গড়ে ২১৫ শতাংশ এবং সবগুলো কৃষি অঞ্চলের মধ্যে সিলেটের অবস্থান একেবারেই নিচে। এ অঞ্চলের শস্যের নিবিড়তা দেশের গড় নিবিড়তার তুলনায় প্রায় ৪৫ শতাংশ কম। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর সর্বশেষ কৃষি বর্ষপঞ্জিতে দেখা গেছে, সারাদেশের মধ্যে রংপুর বিভাগের শস্যের নিবিড়তা সবচেয়ে বেশি। এ অঞ্চলের নিবিড়তা ২২০ শতাংশ। তারপরেই রাজশাহী অঞ্চলের নিবিড়তা ২১৬ শতাংশ। পর্যায়ক্রমে খুলনা অঞ্চলে ২০৬ শতাংশ, ময়মনসিংহ ২০০ শতাংশ, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৯৩ শতাংশ, ঢাকা বিভাগে ১৮৮ শতাংশ, বরিশাল অঞ্চলে ১৬৪ শতাংশ ও সিলেট অঞ্চলে শস্যের গড় নিবিড়তা ১৬৩ শতাংশ। জানা গেছে, বিবিএস ও কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যানে কিছুটা পার্থক্য থাকে সবসময়ই। কৃষি বিভাগ সারাদেশে গড়ে ২১৫ শতাংশ নিবিড়তা দাবি করলেও বিবিএস এর পরিসংখ্যান বলছে বর্তমানে গড় নিবিড়তা ১৯৭ শতাংশ। 

এদিকে, সিলেট আঞ্চলিক অফিসের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট অঞ্চলে মোট ফসলী জমি ১২ লাখ ৯১ হাজার ৭৩৭ হেক্টর। নিট ফসলী জমির পরিমাণ ৭ লাখ ৮৩ হাজার ৩৬৭ হেক্টর। এর মধ্যে এক ফসলী জমি ৩ লাখ ২৫ হাজার ১৬ হেক্টর, দুই ফসলী জমি ৩ লাখ ৬২ হাজার ৭৩২ হেক্টর, তিন ফসলী জমি ৮০ হাজার ৩০৬ হেক্টর। তিনের অধিক ফসলী জমি নেই সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলায়। কেবল হবিগঞ্জ জেলায় ৪৫০ হেক্টর জমিতে তিনের অধিক ফসল উৎপাদন হয়। 

সিলেট অঞ্চলের মধ্যে শস্যের নিবিড়তা সুনামগঞ্জে সবচেয়ে কম। এ জেলায় নিবিড়তা মাত্র ১৪৮ শতাংশ। হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জে বছরের অধিকাংশ সময় পানিতে নিমজ্জিত থাকে। উঁচু জমিতে আমন ও বোরো মৌসুমে বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদন হয় এই জেলায়। মৌলভীবাজার জেলায় নিবিড়তা সবচেয়ে বেশি, ১৮৩ শতাংশ। এছাড়া সিলেট জেলা ১৭৯ শতাংশ এবং হবিগঞ্জ ১৮০ শতাংশ। 

জানা গেছে, ‘সিলেট অঞ্চলের শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ’ প্রকল্পটি হাতের নেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল বিভাগের অনাবাদী থাকা প্রায় ২০ শতাংশ জমি আবাদের আওতায় নিয়ে আসা। কৃষি সম্প্রসারণ বাস্তবায়িত এই প্রকল্পের সহযোগী সংস্থা হিসেবে কাজ করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর (ড্যাম) ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। সিলেটে ধান ছাড়াও ভুট্টা, সরিষা, সূর্যমুখী, ডালসহ সবজিজাতীয় ফসল উৎপাদনে কৃষকদের আগ্রহ কিছুটা বাড়লে প্রতিবছর বিশাল অঙ্কের ফসলি জমি পতিত থাকে। রবি মৌসুমে চার জেলায় পতিত থাকে ১ লাখ ৬৪ হাজার ১৬৮ হেক্টর। সিলেট জেলায় ৬৩ হাজার ৮০৩ হেক্টর, মৌলভীবাজারে ৫০ হাজার ৩৭৬ হেক্টর, হবিগঞ্জে ২৮ হাজার ২০২ হেক্টর এবং সুনামগঞ্জে ২১ হাজার ৭৮৩ হেক্টর। খরিপ-১ মৌসুমে এক লাখ ৪৩ হাজার ৭৭৪ হেক্টর জমি অনাবাদী থাকে। 

‘সিলেট অঞ্চলে শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ’ শীর্ষক এ প্রকল্পের আওতায় সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের ৩০টি উপজেলায় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ওহিদুজ্জামানকে। প্রকল্পের মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। অগ্রগতি সম্বন্ধে জানতে প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে সংযুক্ত করা যায়নি। 

সিলেটের স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল কৃষি জমি কাজে লাগিয়ে শস্যের নিবিড়তা ও শস্য উৎপাদন বাড়ানো। কিন্তু, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আলাদা জনবল নিয়োগ দেয়া হয়নি। অন্যদিকে, উপজেলা পর্যায়ে কৃষি অফিসগুলোতে রয়েছে জনবল সংকট। এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে নিয়মিত ও প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। 

প্রকল্পে দক্ষ ব্যবস্থাপনা কৌশল সম্প্রসারণের মাধ্যমে বসতবাড়ির আঙিনায় সবজি ও উদ্যান ফসল চাষাবাদ করে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো; উন্নত জাত, মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহার, বালাই ব্যবস্থাপনা, কৃষিভিত্তিক পরিচর্যা ও সেচ ব্যবস্থা উন্নয়নের মাধ্যমে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ফসল ব্যবধান কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তবে, কৃষি কর্মকর্তারা এই প্রকল্পের অর্জনের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান দিতে পারেননি। 

জানা গেছে, এ প্রকল্পের মাধ্যমে দুই হাজার ৪৫০ ব্যাচ কৃষক প্রশিক্ষণ, ২ হাজার ব্যাচ উপকারভোগী কৃষক প্রশিক্ষণ, ৫শ’ মাঠ দিবস, কৃষকদের জন্য ১৬০টি উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণ, ৪০ ব্যাচ এসএসও প্রশিক্ষণ ও চার ব্যাচ কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়া ভুট্টা, সরিষা, সূর্যমুখী, কমলা, মসলা, সবজি, ধান, গম, ডাল ইত্যাদি ফসলের ওপর ১৪ হাজার ১১২টি প্রদর্শণীর আয়োজন করা হয়। এর বাইরে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কৃষি মেলার আয়োজন ছিল অন্যতম। এভাবেই মেলা আর প্রদর্শনীর মাধ্যমে শস্যের উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ সীমাবদ্ধ ছিল। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) সিলেট আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপপরিচালক কৃষিবিদ মজুমদার মো. ইলিয়াছ বলছেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধ করায় শস্যের নিবিড়তা কিছুটা হলেও বেড়েছে। ছয় শতাংশ নিবিড়তা বৃদ্ধি একেবারেই কম নয়, তবে আরও বাড়ানোর চেষ্টা আমাদের রয়েছে। সিলেটের অনাবাদী জমিতে উৎপাদনশীল ও লাভজনক শস্য আবাদের ফলে সিলেট অঞ্চলে শস্যের নিবিড়তা এখন বাড়ছে। 

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেটের অতিরিক্ত পরিচালক দিলীপ কুমার অধিকারী দৈনিক সিলেট মিররকে বলেন, নানা কারণে সিলেট অঞ্চলের কৃষি জমির বড় একটা অংশ অনাবাদী থাকে। এক-দুই বছরের মধ্যে এ অবস্থার উত্তরণ সম্ভব নয়। 

বেশ কিছু পরিকল্পনা তার রয়েছে জানিয়ে সিলেটে সদ্য যোগদান করা এই কর্মকর্তা বলেন, সিলেটের ৪০ শতাংশ জমি হাওরবেষ্টিত। বছরের বড় একটা সময়জুড়ে পানিতে নিমজ্জিত থাকে। এ কারণে আউশ আমন আবাদের সময় হাওরের জমি চাষাবাদের বাইরে থাকে। আর রবি মৌসুমে আবাদযোগ্য অনেক জমি পতিত থাকে জমির মালিক অনুপস্থিত থাকার কারণে। এর বাইরেও বেশ কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরেন কৃষিবিদ দিলীপ কুমার অধিকারী। তবুও সমস্যা চিহ্নিত করে কৃষি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে সিলেটের শস্যের নিবিড়তা বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।

এসএইচ/বিএ-১৬