সাইফুল্লাহ হাসান, মৌলভীবাজার
জানুয়ারি ১০, ২০২১
০২:৩১ পূর্বাহ্ন
আপডেট : জানুয়ারি ১০, ২০২১
০৪:৫৭ পূর্বাহ্ন
হাসপাতালের গেটে দাঁড়িয়ে কেউ মোবাইল টিপছেন, কেউ আড্ডা দিচ্ছেন, কেউ বা আবার চা, পান, সিগারেট খাচ্ছেন। কোনো রোগী এলেই ট্রলি নিয়ে হাজির হচ্ছেন তারা। রোগী কাউন্টারে রিসিট কাটার পর ট্রলি ঠেলে নির্দিষ্ট কক্ষে নিয়ে যান তারা। পরে রোগীর স্বজনের কাছে টাকা দাবি করেন। আর এরা হাসপাতালের কেউ নন।
সম্প্রতি মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা হাসপাতাল ঘুরে এমনই চিত্র দেখা গেছে। এই দালালদের হাসপাতালের অলিগলি চেনা। আর অচেনা-অজানা রোগীদের ‘সেবা’ দিয়ে কিছুটা আয় করেন তারা। এদের দৌরাত্ম্য হাসপাতালজুড়ে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, জরুরি বিভাগ থেকে নির্ধারিত বিভাগে রোগীর ট্রলি ঠেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের দিতে হয় ১০০ থেকে ২০০ টাকা।
কুলাউড়া উপজেলার হলিছড়া গ্রাম থেকে সকালে হাসপাতালে এসেছিলেন অঞ্জলী। তিনি তার ভাতিজার স্ত্রীকে গাইনি বিভাগে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এসেছেন। অঞ্জলি জানান, তাদের সঙ্গে কোনো পুরুষ নেই। হাসপাতালে ঢুকতেই দুইজন লোক আসেন। রোগী নেওয়ার জন্য একটা ট্রলি ছিল তাদের কাছে। তারা রোগীকে ট্রলিতে তোলেন তারা। এরপর একবার ২ তলায়, একবার ৩ তলায়, আবার পুরোনো বিল্ডিং থেকে নতুন বিল্ডিংয়ে ট্রলি ঠেলে নিয়ে যান তারা। পরে নতুন বিল্ডিংয়ে এসে গাইনি বিভাগের সামনে ট্রলি দাঁড় করান। এরপর কিছু টাকা দাবি করেন। অঞ্জলী বলেন, ‘আমরাতো অনেক দূর থেকে এসেছি, টাকা পাব কই? আমরা গরিব মানুষ। পরে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করেছি।’
রাজনগর উপজেলার মেদিনিমহল এলাকা থেকে নাবিলকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন তার মা। নাবিলের মা বলেন, ‘হাসপাতালে আসতেই দুইজন এসে নাবিলকে ট্রলিতে তোলেন এবং ৩য় তলায় নির্দিষ্ট কক্ষে নিয়ে যান। পরে তারা টাকা দাবি করেন। ১০০ টাকা দিয়ে তাদের বিদায় করেছি। প্রথমে আমি ভেবেছি এরা হাসপাতালের লোক।’
এই দালালদের বিরুদ্ধে শুধু ‘সেবা’ দিয়ে ‘বখশিশ’ নেওয়া নয়, গুরুতর অভিযোগ রোগী ভাগানোর। হাসপাতালের একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কিছু দালাল উন্নত চিকিৎসার কথা বলে রোগীদের আশেপাশের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে নিয়ে যান। আর আয়া বা ওয়ার্ড বয়রা হাসপাতালের যন্ত্রপাতি খারাপ বলে রোগীদের বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যান। তিনি বলেন, আয়া বা ওয়ার্ড বয়দের সঙ্গে চুক্তি করা থাকে, হাসপাতাল থেকে রোগীকে তাদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে এলে বিলের একটা অংশ তাকে দেওয়া হবে।
তার বক্তব্যের সত্যতার প্রমাণ পেতে এই প্রতিবেদক নিজের পরিচয় গোপন করে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা হাসপাতালের সামনে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত অবস্থান করেন। এ সময় দেখা যায়, কিছুক্ষণ পর পর জলপাই রঙের অ্যাপ্রন পরা নারীরা (হাসপাতালের আয়া) রোগীদের নিয়ে হাসপাতালের পাশের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাচ্ছেন। এই কাজটা তারা খুব তাড়াতাড়ি এবং সতর্কতার সঙ্গে সেরে ফেলেন। ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিসিপশনিস্টদের হাতে রোগী দিয়ে দ্রুত হাসপাতালে ফিরে আসেন তারা। এই দৃশ্য গোপনে ভিডিও করার বিষয়টি তারা টের পেয়ে যান। এরপর অবশ্য তাদের আর দেখা যায়নি। হাসপাতালের পাশের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালের এমন চিত্র প্রতিদিনের।
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. পার্থ সারথি দত্ত কাননগো জানান, হাসপাতাল দালালমুক্ত করতে তাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। কয়েকদিন আগেও এক দালালকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের আয়াদের রোগী নিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাওয়ার বিষয়ে এই তত্ত্বাবধায়ক বলেন, অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের হাসপাতাল থেকে বাদ দেওয়া হবে।
এসএইচ/আরআর-০৭