শামস শামীম ও আবু হানিফ চৌধুরী, শাল্লা
মার্চ ১০, ২০২১
১২:০৩ পূর্বাহ্ন
আপডেট : মার্চ ১০, ২০২১
১২:১৪ পূর্বাহ্ন
হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সুনামগঞ্জের শাল্লায় হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজে জড়িত উপজেলা কমিটি অন্য জেলার এক অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরকে একাধিক প্রকল্পে যুক্ত করেছে। একটিতে সভাপতি, অপরটিতে পিতার নাম বদল করে তাকে সদস্য করে দুর্নীতি ও অনিয়মের পাশাপাশি নামকাওয়াস্তে কাজ করে পুরো বরাদ্দ লোপাটের চেষ্টা চলছে। তাছাড়া যে চক্র অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরকে একাধিক প্রকল্পে যুক্ত করেছে, ওই চক্র মিলে স্বজনদের নামে প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকার ৮টি প্রকল্প হাতিয়ে নিয়েছে। প্রকাশ্যে এমন দুর্নীতি করা হলেও ভয়ে কেউ মুখ খুলছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাল্লায় ফসলরক্ষা বাধ নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদনে জড়িত উপজেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে তথ্য গোপন করে অকৃষক, অন্য জেলার অপ্রাপ্তবয়স্ক বাসিন্দাকে একাধিক প্রকল্পে যুক্তসহ দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এরকম বহু প্রকল্প গ্রহণ ও অনুমোদন শেষে এখন নামকাওয়াস্তে কাজও চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এই প্রতিবেদকদ্বয়ের অনুসন্ধানে এরকম স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে ৮টি প্রকল্পে প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকার প্রকল্প হাতিয়ে নেওয়ার কথা জানা গেছে। শাল্লা উপজেলার চেয়ারম্যান আল আমিন চৌধুরীর মোটরসাইকেলচালক হিসেবে পরিচিত চয়ন চৌধুরী ও চেয়ারম্যানের মৎস্য খামারের প্রহরী হিসেবে কর্মরত কৃপেন্দ্র দাস নামের নামের দুই ব্যক্তি উপজেলা কমিটির মাধ্যমে এমন অপকর্ম করেছেন বলে কৃষকদের অভিযোগ।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডুমরা গ্রামের চয়ন চৌধুরী শাল্লা উপজেলার চেয়ারম্যান আল আমিন চৌধুরীর ব্যক্তিগত মোটরসাইকেলচালক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি নিজেও এই প্রতিবেদককে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। চয়নের ঘনিষ্ট কৃপেন্দ্র দাস উপজেলা চেয়ারম্যানের ঘাগটিয়া জলমহালের প্রহরী। এই দুই ব্যক্তি এবার হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের জন্য গঠিত ১৯, ৬৪, ৬৫, ১০০, ১০১, ১০৩, ১০৪ এবং ১০৫ নম্বর প্রকল্পে নিজের ঘনিষ্টজন, আত্মীয়-স্বজন, অন্য জেলার বাসিন্দা, ভূমিহীন এবং একাধিক প্রকল্পে একই ব্যক্তির পিতার নাম বদল করে তার নামে প্রকল্প আদায় করে নিয়েছেন। প্রকল্প গ্রহণ ও অনুমোদনে অন্যায় সুবিধা নিয়ে অনুমোদন দিয়েছে শাল্লা উপজেলা কমিটি। ইতোমধ্যে বরাদ্দের প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির টাকাও প্রায় উত্তোলন করা হয়েছে। কিন্তু কাজের অগ্রগতি এখনও ভালো নয়। এখনও মুক্তারপুর বড় ক্লোজারটির মাটির কাজ শেষ হয়নি। অন্যান্য প্রকল্পে উপরে প্রলেপ দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও চেষ্টা করছে তারা। অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রকল্পে প্রাক্কলণের নামে পুকুরচুরির সুযোগ করে দিয়েছেন পাউবো'র স্থানীয় কর্মকর্তা আব্দুল কাইয়ুম।
ছায়ার হাওরের ১০০ ও ১০১ নম্বর প্রকল্পে অপ্রাপ্তবয়স্ক অন্তু তালুকদারকে দু'টি প্রকল্পে যুক্ত করা হয়েছে। ১০০ নম্বর প্রকল্পে তাকে সভাপতি করা হয়েছে। ইটনা উপজেলার বাসিন্দা এই কিশোর কাজে অনভিজ্ঞ এবং হাওরে তার কোনো জমি নেই। তিনি চয়ন চৌধুরীর দোকানের কর্মচারী। চতুর চয়ন চৌধুরী শাল্লা উপজেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বরাদ্দ হাতিয়ে নিতে অন্তুকে দু'টি প্রকল্পে যুক্ত করেছেন। ১০০ নম্বর প্রকল্পে তার পিতার নাম ঠিক থাকলেও ১০১ নম্বর প্রকল্পে চয়ন চৌধুরীর বাবা ডুমরা গ্রামের শশাঙ্ক চৌধুরীকে ওই কিশোরের বাবা দেখানো হয়েছে। ১৯ নম্বর প্রকল্পে সদস্য সচিব করা হয়েছে চয়ন চৌধুরীর ভগ্নীপতি মতিলাল চৌধুরীকে, ৬৫ নম্বর প্রকল্পে সভাপতি করা হয়েছে চয়ন চৌধুরীর কাকাতো ভাই পলাশ চৌধুরীকে, ৬৪ নম্বর প্রকল্পে আরেক চাচাতো ভাই বিশ্বজিৎ চৌধুরীকে সভাপতি ও আরেক কাকাতো ভাই হিল্লোল চৌধুরীকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। ১০০ নম্বর প্রকল্পের সদস্য সচিব নূপুর দাসের হাওরে কোনো জমি নেই। ১০১ নম্বর প্রকল্পে অকৃষক অখিল চৌধুরীকে সভাপতি, চয়ন চৌধুরীর ঘনিষ্টজন হিসেবে খ্যাত ও উপজেলা চেয়ারম্যানের মৎস্য খামারের প্রহরী কৃপেন্দ দাসের চাচা ভূমিহীন সুদীপকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। ১০৩ নম্বর প্রকল্পে কৃপেন্দ্র দাসের চাচাতো ভাই ভূমিহীন মিহিরকে সভাপতি, ১০৪ নম্বর প্রকল্পে কৃপেন্দ্র দাসের চাচা ক্ষীতেন্দ্রকে সভাপতি করা হয়েছে এবং ১০৫ নম্বর প্রকল্পে ভূমিহীন কৃপেন্দ্র দাস নিজেই সভাপতি হয়েছেন।
শাল্লা উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ১৯ নম্বর প্রকল্পে ১৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯০১ টাকা, ৬৪ নম্বর প্রকল্পে ১৫ লাখ ৭৩ হাজার ৯৫৫ টাকা, ৬৫ নম্বর প্রকল্পে ১৬ লাখ ৩৯ হাজার ৯৬৯ টাকা, ১০০ নম্বর প্রকল্পে ২৪ লাখ ৯৫ হাজার ৯৭৪ টাকা, ১০১ নম্বর প্রকল্পে ১১ লাখ ৩৯ হাজার ৭৯২ টাকা, ১০৩ নম্বর প্রকল্পে ৯ লাখ ৪৯ হাজার ৭৮৫ টাকা, ১০৪ নম্বর প্রকল্পে ১৪ লাখ ২১ হাজার ৯৩৬ টাকা ও ১০৫ নম্বর প্রকল্পে ১৭ লাখ ৪৭ হাজার ১৩৬ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গতকাল রবিবার পর্যন্ত এসব বাঁধের কাজ শেষ করার নির্দেশনা থাকলেও এখনও কাজ শেষ হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল কাইয়ুম ও তার সার্ভেয়ার টিম অক্ষত বাঁধগুলোকেও নড়বড়ে দেখিয়ে অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্পের লোকদের সঙ্গে মিলেমিশে বিরাট অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
অপ্রাপ্তবয়স্ক অন্তু নিজেকে তালুকদার পরিচয় দিয়ে তার বাড়ি ইটনা উপজেলায় স্বীকার করে জানায়, এখন সে শাল্লায় থাকে। তবে সে কীভাবে এসব প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে তা জানে না। সম্প্রতি চয়ন চৌধুরী ১০০ নম্বর পিআইসি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘১০০ নম্বর পেয়েছি’ লিখে একটি পোস্ট দিয়েছেন। অথচ কাগজে-কলমে তিনি পিআইসি'র কেউ নন।
চয়ন চৌধুরী নিজেকে উপজেলা চেয়ারম্যানের মোটরসাইকেলচালক দাবি করে বলেন, 'অন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক হলেও কোনো সমস্যা নেই। কারণ কাজ করাচ্ছি আমি নিজে। কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে না।' হাওরের বাঁধ বিষয়ে অভিজ্ঞতাহীন এক কিশোরের নিজের ও পিতার নাম বদলে দিয়ে কীভাবে একাধিক প্রকল্পে যুক্ত করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এটা প্রিন্ট মিস্টেক।'
আরেক অভিযুক্ত কৃপেন্দ্র দাস নিজেকে উপজেলা চেয়ারম্যানের ঘাগটিয়া মৎস্য খামারের প্রহরী দাবি করে বলেন, 'আমি ভূমিহীন হলেও বর্গাচাষি। তাই প্রকল্প পেয়েছি।'
শাল্লা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও হাওররক্ষা বাঁধ নির্মাণে যুক্ত উপজেলা কমিটির সভাপতি আল মুক্তাদীর হোসেন বলেন, 'ভূমিহীন, একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি, অপ্রাপ্তবয়স্ক ও নাম বদল করে পিআইসিতে যুক্তদের সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই।' তিনি কোনো অনিয়মে যুক্ত নন বলে জানান।
এ বিষয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান আল আমিন চৌধুরী বলেন, 'এসব বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তবে চয়ন একটি প্রকল্প পেয়েছে বলে জেনেছি।'
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শাল্লা উপজেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আব্দুল কাইয়ুম মুঠোফোনে বলেন, 'আমি মিটিংয়ে আছি।' এটি বলেই তিনি কল কেটে দেন। আর আর কল রিসিভ করেননি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেন, 'এক ব্যক্তি একাধিক প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমন হলে এটি অবশ্যই দুর্নীতি।'
জেলা প্রশাসক ও হাওররক্ষা বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত জেলা কমিটির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, 'অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর নিজের ও পিতার নাম বদল করে পিআইসিতে যুক্ত থাকা একটি অনিয়ম। তাছাড়া প্রকৃত কৃষকদের প্রকল্পে যুক্ত করার কথা। আমি এখনই এসব বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি।'
এসএস/আরআর-০১