বিশ্বজিত রায়, ধর্মপাশা থেকে ফিরে
মার্চ ১৭, ২০২১
১১:১১ অপরাহ্ন
আপডেট : মার্চ ১৭, ২০২১
১১:১১ অপরাহ্ন
এই বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৭০ সালের ৯ অক্টোবর। সেদিন ছিল শুক্রবার। বেলা আনুমানিক ১টা কি দেড়টা। সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার ধারাম ও কাটাকালি হাওরপাড়ের রাজাপুর গ্রাম ও সেখানকার মানুষের মাঝে বেজায় উৎফুল্লতা কাজ করছিল। চারপাশের থৈ থৈ পানিতে খেলা করছিল মৃদু ঢেউ। রোদ্দুররাঙা প্রকৃতির বুকেও যেন দোল খাচ্ছিল এক অজানা শিহরণ। জলমগ্ন হাওরের বুকে জেগে থাকা অজপাড়াগাঁয়ে নেমে এসেছিল স্বতন্ত্র কিছু। সবকিছুতেই ছিল উৎসাহ, উদ্দীপনা আর অবারিত মনে অপেক্ষার ব্রত। কখন এসে ভিড়বে তরী! দু’চোখ ভরে বহু আকাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে শ্রবণ করবে সবাই। অবশেষে পা ফেলে হাওরপাড়ের ওই মাটি ও মানুষকে ধন্য করলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বজ্রকণ্ঠের বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ করলেন সবাইকে। দিয়ে গেলেন মুক্তির বারতা।
বঙ্গবন্ধুর সেই আগমনী বার্তা আজও সসম্মানে বহন করে চলেছে ধর্মপাশা উপজেলার রাজাপুর গ্রাম। ১৯৭০ সালের ৯ অক্টোবর নির্বাচনী প্রচারের অংশ হিসেবে সাচনা, সেলিমগঞ্জ, গোলকপুর হয়ে ধর্মপাশা ওয়াকফ স্টেটের স্বত্বাধিকারী মরহুম মনফর রাজা চৌধুরীর ছেলে ও সুখাইড়-রাজাপুর ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান মনছফ রাজা চৌধুরী মহারাজ মিয়ার বাড়িতে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে তিনি প্রায় সাড়ে ৩ ঘন্টা অবস্থান করেছিলেন। ওইদিন জুমার নামাজ আদায় শেষে খাওয়া-দাওয়া সেরে ওই বাড়ির বাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেন বঙ্গবন্ধু। বক্তব্যে তিনি তাঁর দল আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার মত প্রকাশ করেন।
জাতির পিতার সুখময় স্মৃতি আকড়ে আজ অবধি নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাওরপাড়স্থ মহারাজ মিয়ার ওই বাড়িটি। বাড়ির পুরোনো মসজিদ ও বাংলোঘরটি যেন বহন করে চলেছে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা। সত্যিই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই বাঙালির আগমনে ধন্য হয়েছিল রাজাপুর ও ওই গ্রামের মানুষেরা। এর আগে বঙ্গবন্ধু আসার খবরে রাজাপুর গ্রামের ছোট-বড় সকলের মাঝে প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করতে থাকে। ওইদিন বঙ্গবন্ধুকে নিজ চোখে দেখা রাজাপুর গ্রামের ৮০ বছর বয়সী প্রবীণ গোলাম মোস্তফা ধন মিয়ার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এসব কথা উঠে আসে।
স্বচক্ষে দেখা গোলাম মোস্তফা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি রোমন্থন করে জানান, চেয়ারম্যান মনছফ রাজা চৌধুরী শেখ সাহেব তার বাড়িতে আসছেন- এমন খবর গ্রামবাসীকে জানালে সবার মাঝে বাড়তি উচ্ছ্বাস ও উৎফুল্লতা কাজ করে। জুমার নামাজের ঠিক আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু রাজাপুরে এসে পৌঁছান। কাঠের তৈরি একটি লঞ্চে করে এখানে এসেছিলেন তিনি। এ সময় আব্দুল হেকিম চৌধুরীসহ অনেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। লঞ্চ থেকে নেমেই বঙ্গবন্ধু প্রথমে বাড়ির সামনের মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেন। তিনিও বঙ্গবন্ধুর খুব কাছে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেছেন বলে জানান গোলাম মোস্তফা। প্রায় ৪০-৪৫ মিনিটের নামাজ শেষে বাংলোঘর পার হয়ে সরাসরি চেয়ারম্যানের মূল ঘরে প্রবেশ করেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে বাড়ির সামনের বাংলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেন তিনি। পরে কিছুসময় বিশ্রামের পর লঞ্চযোগে ধর্মপাশা অভিমুখে রওয়ানা দেন বঙ্গবন্ধু।
গোলাম মোস্তফা আরও জানান, দেখতে বড়সড় বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠটা মাইকের আওয়াজের মতো উচ্চস্বরসম্পন্ন। বক্তব্য প্রদানকালে মাইক ছাড়াই তাঁর কণ্ঠে যেন বারুদ বের হয়ে আসছিল। বাঙালির অবিসংবাদিত এই নেতার সঙ্গে হাত মেলানো, খুব কাছ থেকে দেখা ও কাছে দাঁড়িয়ে বক্তব্য শোনাটাই যেন ভাগ্যের ব্যাপার মনে হয়েছে তার কাছে। সে অর্থে তিনি ভাগ্যবান বলে জানিয়েছেন গোলাম মোস্তফা।
মৃত্যুর পরও বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ পেতে চান জানিয়ে তিনি বলেন, 'বঙ্গবন্ধুর সামনে দাঁড়াইয়া বক্তব্য শুনছি। তাঁর ডানে দাঁড়াইয়া নামাজ পড়ছি। কত ভাগ্যবান আমি! তাঁর ডাকে যুদ্ধ শুরু হইল, দেশ স্বাধীন হইল। পরে তাঁরে হত্যা করা হইল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবরে চোখের জল আটকাইয়া রাখতে পারি নাই। এখনও চোখের সামনে ভাইসা ওঠে সবকিছু। নেতার মতো নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু।'
সুখাইড়-রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মনছফ রাজা চৌধুরীর ছেলে আমানুর রাজা চৌধুরী জানান, তাদের বাড়িতে যখন বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন তখন তিনি এক বছরের শিশু। জাতির পিতার আগমনে তাদের বাড়ি বা এ গ্রামই শুধু নয়, এই ইউনিয়নসহ পুরো উপজেলাই ধন্য হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মতো ক্ষণজন্মার পা পড়েছে এই বাড়িতে, তিনি এসেছেন বলেই ইতিহাসের অংশীদার হতে পেরেছেন তারা। এই বাড়ির বাংলো, মসজিদ ও মূলঘর সবখানেই বঙ্গবন্ধুর ছোঁয়া লেগে আছে। তাই বাবার কথা অনুযায়ী পুরো বাড়িটা সংরক্ষণে রাখতে অনেকটা একাকী বসবাস করছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি রক্ষায় বাংলো ঘরটিকে জাদুঘর বানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন আমানুর রাজা চৌধুরী।
বিআর/আরআর-০১