সাইদুর রহমান আসাদ, সুনামগঞ্জ
মে ২২, ২০২১
০৪:৪০ পূর্বাহ্ন
আপডেট : মে ২২, ২০২১
০৪:৪০ পূর্বাহ্ন
বজ্রপাতে নিহত ফরিদ মিয়ার স্ত্রী রুমী বেগম ও সন্তানরা
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হবিবপুর ইউনিয়নের নারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা শঙ্কর সরকার (২২)। তার বাবা মারা গেছেন ১৪ বছর আগে। মা ও ৩ বোন নিয়ে ৪ সদস্যের সংসার তার। পিতাহীন সংসারে অনেক কষ্ট করে ২ বোনকে বিয়ে দিয়েছেন। ভেবেছিলেন ছোট বোন রুম্পা রানী দাসকে পড়াশোনা করিয়ে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে নিজেও সংসার পাতবেন। কিন্তু গত বছরের ১৮ এপ্রিল হাওরে ফসলের জমিতে যাওয়ার পথে বজ্রপাতে মারা যান তিনি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে বর্তমানে পরিবারটির পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
শঙ্কর সরকারের ভগ্নীপতি রাতুল দাস সিলেট মিররকে বলেন, আমার শাশুড়ির নাম রেবা রানী দাস। শ্বশুর মারা গেছেন প্রায় ১৪ বছর হলো। একমাত্র ছেলেকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে ছিলেন তিনি। কিন্তু সেই ছেলেও গেল বছর বজ্রপাতে মারা গেছেন। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তারা এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
বর্তমানে দুই সদস্যের পরিবারটি কীভাবে চলে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি মোটরসাইকেল চালাই। আমারও দুই ছেলে-মেয়ে রয়েছে। তবু কষ্ট করে হলেও আমিই তাদের দেখাশোনা করি।
ছেলেহারা রেবা রানী দাস বলেন, আমার ছেলে থাকতে অভাব বুঝিনি। পরিবারের সকল খরচ সে-ই বহন করত। সে মারা যাওয়ার আগে থেকে কিছু জমিজমা ছিল, সেগুলো বন্ধক এখন দিয়ে পরিবার চলছে। আমার বড় মেয়ের স্বামীও দেখাশোনা করে। এখন আমাকে নিয়ে চিন্তা করি না। ঘরে থাকা মেয়েকে নিয়েই চিন্তা। তার বিয়ের বয়স হয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যৎ কী জানি না।
শঙ্কর সরকারের ছোট বোন রুম্পা রানী দাস শাল্লা ডিগ্রি কলেজ থেকে এবার এইসএসসি পাস করেছেন। এতদিন শঙ্কর তার পড়াশোনার খরচ যুগিয়েছেন। এখন তার অনুপস্থিতিতে অভাব-অনটনের কারণে আর পড়াশোনা করতে চান না রূম্পা।
রুম্পা রানী দাস বলেন, আমার বাবা আমাদের ছোটবেলায় মারা গেছেন। পরে সংসারের হাল ধরেন আমার একমাত্র ভাই। আমার ভাই নিজে পড়াশোনা না করে আমাকে পড়াশোনা করিয়েছেন। নিজে অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালিয়েছেন। এখন সংসারই চলে না, পড়াশোনা করব কীভাবে? তাই আর পড়াশোনা করব না ভেবেছি।
জেলা দুর্যোগ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্রে জানা যায়, গেল ৩ বছরে সুনামগঞ্জে ৩৬ জন বজ্রপাতে মারা গেছেন। তারা সবাই সাধারণ কৃষক। এই কৃষিকাজ করতে গিয়েই বজ্রপাতে মারা গেছেন তারা। এর মাঝে সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন দিরাই উপজেলায় ১২ জন। জামালগঞ্জ উপজেলায় মারা গেছেন ৯ জন। এছাড়া ধর্মপাশা উপজেলায় ৮ জন, দোয়ারাবাজার উপজেলায় ৭ জন, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় ২ জন, তাহিরপুর উপজেলায় ২ জন, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় ২ জন, ছাতক উপজেলায় ২ জন, জগন্নাথপুর উপজেলায় ১ জন, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় ১ জন ও শাল্লা উপজেলায় ১ জন বজ্রপাতে মারা গেছেন।
গত বছর দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পাঁচগুইয়া হাওরে ধান কাটার সময় ফরিদ মিয়া (৩৫) নামের এক কৃষক মারা যান। ফরিদ উপজেলার পাথারিয়া ইউনিয়নের গাজীনগর গ্রামের আমিরুল ইসলামের ছেলে। তার স্ত্রীসহ ৫ ছেলে-মেয়ে রয়েছে। ফরিদ মারা যাওয়ায় তার তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া বড় ছেলে পাবেল এখন আর বিদ্যালয়ে যায় না। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে সংসার চলছে তাদের।
ফরিদ মিয়ার স্ত্রী রুমী বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, গত বছর হাওরে গিয়েছিলেন আমার স্বামী। সঙ্গে ২টি গরু ছিল। অকস্মাৎ বজ্রপাতে তিনি মারা যান। ২টি গরুও মরে যায়। এখন মানুষের কাছে বলে-কয়ে সহায়তা নিয়ে সংসার চালাচ্ছি। অভাবের জন্য সন্তানদের বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে কাজে পাঠাই।
সংসার কীভাবে চলে- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার ভাই একজন ওমানে থাকে। সেখান থেকে কিছু টাকা পাঠায়। সেই টাকা দিয়েই কোনোমতে সংসার চালাই। নিজের জায়গা-জমি নেই। অন্যের জমিতে ছোট একটা ঘর বানিয়ে থাকি। এখন সেই ঘরটাও ভেঙে যাচ্ছে। একটু বৃষ্টি হলেই ৫ সন্তানকে নিয়ে খাটের তলায় আশ্রয় নিই।
গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর একই উপজেলার পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের ইসলামপুর (নতুন পাড়া) গ্রামের বাসিন্দা রইব্বা মিয়ার ছেলে মিঠু মিয়া (২৮) বজ্রপাতে মারা যান। দক্ষিণ সুনামগঞ্জের দেখার হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে তিনি বজ্রপাতে নিহত হন। তার পরিবারে ২ বোন ও ১ ভাই রয়েছে। তার মৃত্যুতে ছোট ভাই দুদু মিয়া (২২) ঢাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি করে সংসারের হাল ধরেছেন। দুই বোনের মাঝে পারভিন বেগমের বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রাম উসলপুর জামখলায়। সবার ছোট মেয়ে চন্দনা আক্তারকে নিয়ে মা সাবিয়া বেগম গ্রামের বাড়িতে থাকেন।
মিঠু মিয়ার ছোট বোন চন্দনা আক্তার বলেন, আমার মায়ের অসুখ। টাকার জন্য চিকিৎসা করাতে পারছি না। বড় ভাই গত বছর মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা গেছেন। এরপর থেকে আরেক ভাই ঢাকায় কাজ করে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছেন। এখন এই এক ভাইয়ের রোজগার দিয়েই সংসার চলছে।
জগন্নাথপুর উপজেলায় বাউধরন গ্রামের তবারক মিয়ার ছেলে শিপন মিয়া (৩৩) হাওরে গরু চড়াতেন। সারা গ্রামের গরু তিনিই দেখাশোনা করতেন। বিনিময়ে গ্রামবাসী যা দিত, তা দিয়ে চলত তার সংসার। অন্যান্য দিনের মতো গত বছরের ১৮ এপ্রিল গরু নিয়ে মাঠের উদ্দেশে বের হয়েছিলেন তিনি। পরে সেখানেই বজ্রপাতে তিনি মারা যান। বর্তমানে তার স্ত্রী, ১ ছেলে ও ১ মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়ের বয়স আড়াই বছর। তিনি মারা যাওয়ার ৩ মাস পর ছোট ছেলের জন্ম হয়েছে। বর্তমানে পরিবারটি আর্থিক সংকটে রয়েছে। শিপন মিয়ার বড় আরও ৩ ভাই থাকলেও তাদেরও অভাব-অনটনের সংসার। শিপন মিয়ার স্ত্রী শেফালি বেগমকে সহযোগিতা করার ক্ষমতা নেই বলে জানিয়েছেন তারা।
শিপন মিয়ার বড় ভাই ফুলসাদ মিয়া বলেন, আমাদের অভাবের সংসার। একবেলা খেলে আরেক বেলা উপোস থাকতে হয়। তাই আমরা তাদের সহায়তা করতে পারি না।
শিপন মিয়ার স্ত্রী শেফালি বেগম বলেন, ভিটায় যে ঘর ছিল, সেটা ভেঙে গেছে। বৃষ্টি হলে দৌড়ে আরেকজনের ঘরে আশ্রয় নিই। মানুষের কাছ থেকে সহায়তা এনে ছেলে-মেয়ের মুখে ভাত তুলে দেই। মানুষ যা দেয়, তা দিয়েই সংসার চালাই। না দিলে উপোস থাকি।
এদিকে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে যারা মারা গেছেন, তারা সবাই কৃষক। জমিতে ফসল ফলাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা গেছেন তারা। অনেকের পরিবারের একমাত্র উর্পাজনক্ষম ব্যক্তি চলে যাওয়ায় পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। বর্তমানে তারা অসহায় অবস্থায় দিন পার করছেন। তাদের পরিবারের পুনর্বাসন ও অর্থনেতিক সংকট দূর করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন।
হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার সিলেট মিররকে বলেন, এই কয়েক বছরে হাওরে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। অথচ ৫০ বছর আগেও বজ্রপাতে এত মৃত্যু ছিল না।
প্রকৃতিকে ধ্বংস করে উন্নয়নের পাশাপাশি মোবাইল টাওয়ারগুলোর একটি থেকে আরেকটির সঠিক দূরত্ব না থাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক সময় বজ্রপাতে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ মোবাইল টাওয়ারের মাধ্যমে ভূগর্ভে চলে যায়। কিন্তু দু'টি মোবাইল টাওয়ারের মধ্যে সঠিক দূরত্ব না থাকলে বজ্রপাত থেকে সৃষ্ট বিদ্যুৎ হাওরের খোলা জায়গায় পড়ে যায়। এতে সাধারণ কৃষক মারা যায়।
সুনামগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট খলিল রহমান সিলেট মিররকে বলেন, হাওরে বজ্রপাতে যারা মারা গেছেন তারা এলাকার ছোট কৃষক, অনেকে শ্রমিক। তাদের উপরেই নির্ভরশীল ছিল পরিবার। আমরা দেখেছি তাদের পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক ২০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি এই ২০ হাজার টাকা সহায়তা যথেষ্ট নয়। তারা যেহেতু আমাদের খাদ্য যোগান দেন, তাই তাদের পরিবারকে নিয়ে সরকারে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। এজন্য তাদের সন্তানদের পড়াশোনার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। পাশাপাশি বজ্রপাত রোধে শুধু সভা-সেমিনার নয়, বরং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি পঙ্কজ দে সিলেট মিররকে বলেন, আমাদের খাবার উৎপাদন করতে গিয়ে হাওরে বজ্রপাতে মারা যান তারা। প্রতি বছরই বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরকম মৃত্যু রোধ করাসহ তাদেরকে ২০ হাজার টাকা সহায়তা না দিয়ে এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সারা জীবন তাদের পরিবার স্বাচ্ছন্দে চলতে পারে। তাদের যেন অর্থনৈতিক সংকটে না থাকতে হয়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে।
সুনামগঞ্জ জেলা দুর্যোগ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম সিলেট মিররকে বলেন, যারা বজ্রপাতে মারা গেছেন তাদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। যদিও অনেক পরিবারে উপর্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে এই ২০ হাজার টাকা কিছুই না। এতে অনেকে অর্থনৈতিক সংকটে থাকলেও তাদেরকে এর চেয়ে বেশি সহযোগিতা করার সুযোগ আমাদের নেই।
সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও বিরোধীদলীয় হুইপ পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ সিলেট মিররকে বলেন, সংসদে এর জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ নেই। দুর্যোগ মন্ত্রণালয় থেকে যেটা দেওয়া হয়, এর বাইরে সহায়তা করার কোনো সুযোগ নেই। সরকারিভাবেও নিয়মিত ভাতা প্রদানের কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে স্থানীয় ইউনিয়ন থেকে সরকারি সহায়তা ভিজিএফ কার্ডের চাল বা ৩০ কেজি চাল দেওয়ার কার্ড চেয়ারম্যান ব্যবস্থা করে দিলে তাদের জন্য ভালো হয়।
এএম/আরআর-০৮