অযত্নে, অবহেলায় জলাবদ্ধ সুনামগঞ্জের শহীদ মিনার

সাইদুর রহমান আসাদ, সুনামগঞ্জ


জুন ০৩, ২০২১
০৯:৪৭ অপরাহ্ন


আপডেট : জুন ০৩, ২০২১
০৯:৪৭ অপরাহ্ন



অযত্নে, অবহেলায় জলাবদ্ধ সুনামগঞ্জের শহীদ মিনার

টানা দুইদিনের বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে দেশে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রথম নির্মাণ করা সুনামগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। এই জলাবদ্ধতার জন্য শহীদ মিনারের পবিত্রতা নষ্ট হচ্ছে। পানি সরাতে নেই প্রশাসনের কোনো তৎপরতা। এতে ক্ষোভ জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ জেলার সচেতন মানুষ।

জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ জেলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধারা এই শহীদ মিনারটি নির্মাণ করেন। এই শহীদ মিনারে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে প্রথম বিজয় দিবস উদযাপন করেন জেলার সর্বস্তরের মানুষ। পরবর্তীতে সকল আন্দোলন-সংগ্রাম ডিএস রোডের পাশে অবস্থিত এই শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন হয় এই শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে।

শহরের সংস্কৃতিকর্মীরা বলছেন, সুনামগঞ্জের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি সারা বছর অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকে। শুধু শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের আগে শুরু হয় ধোয়া-মোছা আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ। আর বছরের বাকি সময় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে দেখা যায় ময়লা-আবর্জনা ও পানি জমে থাকতে। এতে তরুণ প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যথাযথ মর্যাদা, পবিত্রতা ও ভাবগাম্ভীর্য রক্ষার বিষয়টি তৈরি হচ্ছে না।

সাধারণ মানুষ বলছেন, নতুন প্রজন্মের কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা বিকৃত হচ্ছে শহীদ মিনার অযত্নে-অবহেলায় থাকার ফলে। এতে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা প্রকাশ পাচ্ছে। বৃষ্টি হবে, ময়লা আবর্জনা জমবে। তা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। অযত্ন-অবহেলার কারণেই শহীদ মিনারে একটু বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এতে নতুন প্রজন্মের ধারণা তৈরি হচ্ছে শহীদদের স্মরণে নির্মিত এই স্থাপনাটি অবহেলায় থাকে, গুরুত্ব কম এটির। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শ্রদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস জানার কৌতুহল সৃষ্টি হচ্ছে না তাদের মাঝে। স্থানীয় প্রশাসন এই দায় এড়াতে পারে না।

'সুনামগঞ্জ প্রসেনিয়াম' নামের নাটকের দলের দলনেতা দেবাশীষ তালুকদার শুভ্র বলেন, একবার ১৬ ডিসেম্বর রাতে দেখি শহীদ মিনারে বাতি নেই। অথচ সারা শহর আলোকিত। এটি নিয়ে প্রতিবাদ করেছি আমরা। পরে আলো এসেছে। বলতে গেলে প্রশাসন এটি কোনো সময়ই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে না। শহরের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন এটি পরিষ্কার করে রাখে।

জেলা উদীচী’র সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শহীদ মিনার আমাদের চেতনার সঙ্গে মিশে রয়েছে। বাঙালির অহঙ্কার, আবেগ এই শহীদ মিনারকে ঘিরে। শহীদ মিনারে বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হবে সেটা আমরা মানব না। শহীদ মিনার পবিত্র স্থান। কিন্তু পবিত্রতা রক্ষা হচ্ছে না। আমরা সকল অনিয়ম, অন্যায়ের প্রতিবাদ করি শহীদ মিনারে গিয়ে। বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতার কারণে শহীদ মিনার কেন্দ্রিক অনুষ্ঠান করতে পারি না। ফলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন প্রজন্মের অনেক কিছুই অজানা থেকে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে তৈরি হচ্ছে না তারা।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক ও সাংবাদিক শামস্ শামীম বলেন, বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার আমাদের। এটির প্রতি অবহেলা মানে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবহেলা। শহরের রাস্তাঘাটে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে, শুধু আমাদের চেতনার বাতিঘর শহীদ মিনার থাকে অবহেলায়। একটু বৃষ্টি হলে পানি জমে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়।

জেলা সিপিবি’র সভাপতি অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, লুটপাটের ধারাবাহিকতায় শহীদ মিনারকেও মানুষের কাছে অশ্রদ্ধার পাত্র করে গড়ে তোলার আরেকটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকে। তরুণ প্রজন্ম দেখছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানেই এসব অপর্কম করা। শহীদ মিনার হলো ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরে দামি ফুলের তোড়া দেওয়া।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজেদের হাতে গড়া শহীদ মিনার এটি উল্লেখ করে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার নুরুল মোমেন বলেন, নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারছে না। জানার আগ্রহ তৈরি হচ্ছে না তাদের। কারণ তারা দেখছে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ অযতœ-অবহেলায় পড়ে আছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা ৩ বছর আগে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছি। এখন প্রশাসন শহীদ মিনারের দেখভাল করার কথা। কিন্তু তারা সে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। বৃষ্টি হলে এখানে পানি জমে যায়। আগে পৌরসভা দেখাশোনা করত। এখন তারাও সেটি করে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এটি দেখাশোনা করে পৌরসভা, কিন্তু পৌরসভা এটি নিয়ে কোনো কাজ করতে পারছে না। কারণ জায়গাটি নিয়ে আদালতে একটি মামলা রয়েছে। এজন্য খুব তাড়াতাড়ি সুনামগঞ্জে একটি আধুনিক দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হবে।


এএম/আরআর-০২