অবহেলায় অরক্ষিত বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য সেই বটতলা

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ


আগস্ট ১৪, ২০২১
১১:৩০ অপরাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ১৫, ২০২১
০৭:০৯ অপরাহ্ন



অবহেলায় অরক্ষিত বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য সেই বটতলা

সাচনা বাজার বটতলা। ১৯৭০ সালের অক্টোবরের পর থেকে অখ্যাত বটতলার সঙ্গে ঐতিহাসিক শব্দটি যোগ হয়। ৭০ এর নির্বাচনী প্রচারে সাচনা বাজারে এসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বটতলার মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেন। তখন থেকে ঐতিহাসিক বটতলা হিসেবে খ্যাতি লাভ করে জামালগঞ্জের সাচনা বাজারের উত্তরদিকের শতবর্ষী বটগাছ ও এর তলদেশ।

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য ঐতিহাসিক এ বটগাছটি ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। এর মাঝে গাছটির কত পাতা ঝরেছে মাটিতে, ভেঙেছে তার ডালপালা। ৫১ বছর আগের বটতলার কর্দমাক্ত মাটি এখন বালু-পাথর-সিমেন্টের প্রলেপে ঢাকা পড়েছে। ৭০ সালে বজ্রকণ্ঠের বক্তব্য শুনে টগবগিয়ে ওঠা তদানীন্তন পরাধীন গাছটি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অতিক্রম করার সুসময়ে এসে জাতির পিতার সুখময় স্মৃতি আকড়ে আজও নির্বাক বেদনায় ভেসে চলেছে। অযত্ন, অবহেলা ও সংরক্ষণের অভাবে চাপা পড়তে বসেছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এই মহামূল্যবান স্মৃতিচিহ্নটুকু। মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর ও বঙ্গবন্ধুর সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ঐতিহাসিক এই বটতলা সংরক্ষণের জোর দাবি জানিয়েছেন এলাকার সচেতন মহল।

যতটুকু জানা যায়, ১৯৭০ সালের ৮ অক্টোবর নির্বাচনী প্রচারে জামালগঞ্জের সাচনা বাজারে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তারই অংশ হিসেবে তিনি সাচনা বাজারস্থ বটতলায় এক বিশাল জনসমাবেশে মিলিত হন। এর আগে লঞ্চযোগে এসে নামেন সাচনা বাজারের কোম্পানিঘাটে। বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখা ও তাঁর কথা শোনার জন্য অন্তত ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ সুরমা নদীতে সারি সারি নৌকায় অবস্থান নেন। পরে সভা শেষে বঙ্গবন্ধু প্রয়াত আব্দুর রহমানের সাচনা বাজারস্থ বাসায় দুপুরের খাবার খেয়ে লঞ্চযোগে পরবর্তী গন্তব্যে রওয়ানা হন। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এমনটি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

বটতলার মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে থাকা ঋষিকেশ রায়ের লেখা ডায়রি থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে সেদিন মানপত্র পাঠ করেছিলেন তিনি। সাচনা বাজার ভাটি এলাকা হওয়ায় জনসভার জায়গা ছিল কম। ডাঙায় মানুষের জায়গা সংকুলান না হওয়ায় ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ বিভিন্ন নৌকায় জমায়েত হয়েছিলেন।

ঋষিকেশ রায় তার লেখনীতে উল্লেখ করেন, তার জীবনের সবচেয়ে বড় সঞ্চয় ছিল বঙ্গবন্ধুর পবিত্র বক্ষের সঙ্গে তার বক্ষের মিলন। বঙ্গবন্ধুর উষ্ণ বক্ষের তেজ তিনি অনুভব করেছেন। আলিঙ্গনরত অবস্থায় বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, ‘ভাই, আমার বাংলা মায়ের জন্য যথাসাধ্য করবেন।’

সাচনা গ্রামের বাসিন্দা ও অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্র আরিফ বাদশাহ বলেন, ছোটবেলায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের গল্প শোনার সময় জানতে পারি বর্তমান সাচনা বাজারে (তৎকালীন কালীগঞ্জ বাজার) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লঞ্চযোগে আসেন এবং তিনিই সাচনা বাজার নামকরণ করেন। সে সময়ের বটতলার জনসভায় অনেক মানুষ হয়েছিল। সে অর্থে জায়গাটি ঐতিহাসিক হলেও বাস্তবে ইতিহাসের কোনো ছিটেফোঁটা কিংবা চিহ্ন নেই। বর্তমান প্রজন্ম জানেই না কেন এটাকে ঐতিহাসিক বটতলা বলা হয়। কলেজে পড়ার সময় জায়গাটা সংরক্ষণের জন্য সহপাঠীদের নিয়ে প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও উপজেলা চেয়ারম্যান ইউসুফ আল আজাদ সাহেবের সঙ্গে কথা বলে দাবি পেশ করেছিলাম। কিন্তু তার বাস্তবায়ন আজও হয়নি। দ্রুত এই ঐতিহাসিক জায়গাটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

জামালগঞ্জের নাট্যব্যক্তিত্ব সমরেন্দ্র আচার্য্য শম্ভু বলেন, বঙ্গবন্ধু সত্তরের নির্বাচন পূর্ববর্তী সাচনা বাজারের বটতলায় বক্তব্য প্রদানের পর থেকে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এখানকার মানুষ। যার ফলশ্রুতিতে জামালগঞ্জ আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি পায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক বটতলা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তার ঐতিহাসিক রূপ হারাতে বসেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ সরকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পদস্পর্শে ধন্য বটতলা সংরক্ষণ জরুরি। এতে আগামী প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনা সম্পর্কে জানতে পারবে।

‘সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধু ও তৎকালীন রাজনীতি’ নামক বইয়ের লেখক কল্লোল তালুকদার বলেন, সাচনা বাজারের বটতলায় বঙ্গবন্ধুর জনসভা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সবারই দাবি থাকবে এই জায়গাটা সংরক্ষিত হোক। স্বাধীনতার পক্ষের যারা আছেন, মনে হয় না তারা কেউই এর সঙ্গে দ্বিমত করবেন। এই বটতলায় বঙ্গবন্ধু হাওরপাড়ের মানুষের জীবনমান নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্বার্থে এই তাৎপর্যপূর্ণ স্থান সংরক্ষণ করা জরুরি। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এ দাবি রইল।

জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব বলেন, এই ঐতিহাসিক জায়গাটি সংরক্ষণের ব্যাপারে আমাদের চিন্তা-ভাবনা আছে। আমরা এ ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিচ্ছি এবং তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা ভাবছি।

এ ব্যাপারে সংরক্ষিত (সিলেট-সুনামগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শামীমা আক্তার খানম বলেন, সাচনা বাজারের বটতলা একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। এখানে এসে বঙ্গবন্ধু ভাষণ প্রদান করেছিলেন। এছাড়া ভাটির আন্দোলন, সংগ্রাম ও সভা-সমাবেশের সঙ্গে এই বটতলা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটিকে সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। এই স্মৃতি সংরক্ষণে সকলকে উদ্যোগী হওয়া জরুরি।


বিআর/আরআর-১১