পর্যটকরা এসে সৌন্দর্যে মাতেন, অভাবে গ্রাম ছাড়েন হাওরবাসী

শামস শামীম, টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ফিরে


আগস্ট ২৮, ২০২১
১০:১৬ অপরাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ২৯, ২০২১
১২:৩৩ পূর্বাহ্ন



পর্যটকরা এসে সৌন্দর্যে মাতেন, অভাবে গ্রাম ছাড়েন হাওরবাসী
টাঙ্গুয়ার হাওরবাসীর নীরব কান্না-১

স্থলজ-জলজ জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বিশ্ব ঐতিহ্য টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা দেশ-বিদেশের পর্যটকদের জানা। সুযোগ পেলেই দেহ-মন সতেজ করতে তারা টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে আসেন বর্ষা ও শীতে। অনেক অবস্থাপন্ন পর্যটক জায়গা-জমি কিনে ব্যবসাও শুরু করেছেন সেখানে। পর্যটকদের জন্য তৈরি করেছেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যিক নৌকা বা বজরা। পর্যটকরা যখন হাওরে বজরায় আনন্দে মাতেন, তখন বিষণ্ণ বেদনায় আঁতকে ওঠেন ওই হাওরের বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা। হাওরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় তারা ঘরবাড়ি ছেড়ে রাজধানী ঢাকার পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজের আশায় ছুটছেন। এই করোনাকালেও গ্রাম ছাড়ছেন তারা। এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ায় তাদের সন্তানদের পড়ালেখাও অনিশ্চিয়তার মুখে পড়েছে। বিপর্যয়ে পড়েছে কৃষি অর্থনীতিও। 

৯৭.২৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের টাঙ্গুয়ার হাওরটি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার ছোট-বড় ৮৮টি গ্রাম দ্বারা বেষ্টিত। গ্রামগুলোর ৮০ হাজার জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ মৎস্যজীবী, ৬০ শতাংশ কৃষিজীবী এবং ১০ শতাংশ মানুষ অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত। ২০০৩ সাল থেকে দাতা সংস্থা আইইউসিএন দেশীয় কয়েকটি এনজিওকে নিয়ে হাওর ব্যবস্থাপনায় ছিল। ২০১৭ সালে চলে গেছে আইইউসিএন। সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে পরিবেশ ও প্রকৃতি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কার্যক্রম গ্রহণ করা হলেও অভিযোগ উঠেছে সংরক্ষণকালেই পরিবেশ ধ্বংস করা হয়েছে। গাছ, মাছ, পাখিশুন্য হয়ে গেছে টাঙ্গুয়ার হাওর। এখন হাওরের অরক্ষিত অবস্থার সুযোগে আন্তর্জাতিক সংরক্ষিত এলাকা হওয়ার পরও তা পর্যটকদের দখলে চলে গেছে। এই করোনার মধ্যেও থেমে নেই পর্যটকদের আনাগোনা। হাওরের সংরক্ষিত এলাকায় তারা নোঙ্গর ফেলে আনন্দ উদযাপন করছেন।

গোলাবাড়ি, জয়পুর, ছিলাইন তাহিরপুর, রনচি ও মন্দিআতা টাঙ্গুয়ার হাওরের নিকটস্থ গ্রাম। গ্রামগুলো এ হাওরের কেন্দ্রে অবস্থিত। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই হতদরিদ্র। উত্তরাধিকার সূত্রে তারা হাওরে মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। আইইউসিএন সংরক্ষণে আসার পর বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না করে তাদের জীবিকার পথ মাছ ধরা বন্ধ করে দেয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাদের জাল, নৌকাসহ মাছ ধরার যন্ত্রপাতি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপরই গ্রামগুলোতে বিপর্যয় নামে। ওই সময়ে ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে একটি মধ্যস্বত্ত্বভোগী গোষ্ঠী চুরি করে মাছ ধরা শুরু করে। এই চক্রের কারণেই এখন হাওরের পরিবেশ আরও সংকটাপন্ন বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। 

গোলাবাড়ি গ্রামের আশি উর্ধ্ব প্রবীণ ব্যক্তি গোলাম মোস্তফা বলেন, আমাদের গেরামটা অভাবী। অভাবের কারণে অনেক পরিবার ঢাকায় গেছেগা। ঢাকা থাইক্যা আবার উল্টাবায় আইয়া মানুষ টেকা-পয়সা রুজি কইরা যায়। আর আমরা দিন দিন গরিব অই। না মাছ ধরতে পারি, না কাম করতে পারি।

একই গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব গৃহিণী মজিদা খাতুন বলেন, আমরার গেরাম থাইক্কা সাদ্দাম, সায়েদ, আবুল কাশেম, সেলিম, সবুজ, সাগর, মুজিবুর, সোহাগ ও তওফিকের পরিবার ঢাকায় গেছেগা। টাঙ্গুয়ার পাড়ো থাইক্যা আমরার রুজি নাই। বাইস্যা মাসো ঘরো বাইয়া থাকি। এখন সবাই জি-পুত বাঁচানোর লাগি ঢাকায় চইল্যা যায়।

একই গ্রামের গৃহিণী খুকি সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা গেরামের মানুষ কষ্টে আছি। কামাই-রুজি করতাম পারি না। মাছ ধরতাম পারি না। মাছ ধরতে গেলেও মাছ নাই। টাঙ্গুয়ার মাছ লুট অইগেছে। কত কত মানুষ আউর দেখতে আয়, আমরার লাগি তারা কুনুস্তা করে না।

গ্রামের বাসিন্দা খসরু মিয়া বলেন, আমাদের গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই গরিব। বৈশাখে সামান্য বোরো ধান ছাড়া আর কিছু পায় না তারা। বর্ষায় মানুষ ঢাকায় কাজ করতে চলে যায়। আমাদের গ্রামের অভাবী অনেক পরিবার ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের কাছে জায়গা-জমি বিক্রি করে দিয়েছে। আর পর্যটকরা ব্যবসা করতে সুন্দর সুন্দর নৌকা তৈরিসহ নানা কিছু করছেন। তারা কেউ টাঙ্গুয়ার মানুষের জন্য কিছু করছেন না।

তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণাসিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের সুনাম বিশ্বময়। দেড় দশকের ব্যবস্থাপনায় আমাদের কোনো লাভ হয়নি। হাওরের জনগণের কোনো উপকারে আসেনি ব্যবস্থাপনা। হাওরের প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষার বদলে বিনষ্ট হয়েছে। এখন দিন দিন পর্যটকরা আসছে। বাইরের ব্যবসায়ীরা টাঙ্গুয়াকে কেন্দ্র করে ব্যবসা করলেও আমাদের হাওরের গরিব মানুষদের জন্য কিছু করছেন না।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, হাওর একফসলি এলাকা। বর্ষাকালীন ৬ মাস কোনো কাজ থাকে না। তাছাড়া হাওরে এখন আগের মতো মাছ নেই। বিকল্প আয়ের সুযোগ নেই। তাই টাঙ্গুয়ার হাওরসহ অন্যান্য হাওরপাড়ের মানুষজন ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে কাজের সন্ধানে যাচ্ছেন। আমরা তাদের জন্য বিকল্প আয়ের পথ বের করার চিন্তা করছি।

প্রসঙ্গত, টাঙ্গুয়ার হাওরে রয়েছে ৫২টি বিল, ১২০টি কান্দা-জাঙ্গাল জুড়ে রয়েছে ১৪১ প্রজাতির মাছ, ২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২১৯ প্রজাতির পাখি, ৯৮ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি, ১২১ প্রজাতির দেশি পাখি, ২২ প্রজাতির পরিযায়ী হাঁস, ১৯ প্রজাতির স্তন্যপ্রায়ী প্রাণী, ২৯ প্রজাতির সরিসৃপ, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণীসহ অসংখ্য স্থলজ, জলজ প্রাণী ও জীববৈচিত্র। দেশের সর্ববৃহৎ হিজল করচের বাগান রয়েছে এই হাওরে।


এসএস/আরআর-১০