হাওরে উচ্চশিক্ষার পথ দুর্গম, বন্ধ হয়নি বাল্যবিয়ে

শামস শামীম, টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে এসে


আগস্ট ৩০, ২০২১
০৭:৫১ অপরাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ৩১, ২০২১
১২:১৩ পূর্বাহ্ন



হাওরে উচ্চশিক্ষার পথ দুর্গম, বন্ধ হয়নি বাল্যবিয়ে
টাঙ্গুয়ার হাওরবাসীর নীরব কান্না-৩

ছবি- সংগৃহীত

‘আমরার গেরামের ফোলাফাইন হাইস্কুল-কলেজে যাইত ফারে না। এর আগেই ফড়ালেখা বন্ধ হইয়া যায়। আমরার গেরামের ছাত্ররা প্রাইমারি পইড়া আর পড়ে না। সবাই বাদ দিয়া দেয়। আমিও প্রাইমারি ইস্কুল পাশ কইরা বাদ দিয়া দিছি। অনে কাম-কাজ কইরা সংসার চালাই।’ 

টাঙ্গুয়ার হাওরের গ্রাম গোলাবাড়ির কিশোর অমিত হাসান লিয়ন তার গৃহিণী মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে এভাবেই উচ্চশিক্ষার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা বলছিল। শুধু লিয়নই নয়, ওই গ্রামের ৯৫ ভাগেরও বেশি কিশোর-কিশোরী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হয়ে আর মাধ্যমিকে যেতে পারে না। বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলো থেকে মাধ্যমিক স্কুলের পথ অনেক দূরে থাকায় এবং কাছাকাছি স্কুল না থাকায় এভাবেই টাঙ্গুয়ার হাওরের দুর্গম গ্রামগুলোর কোমলমতি শিশু-কিশোরদের উচ্চশিক্ষার পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে কিশোরী মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে অল্প বয়সে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, টাঙ্গুয়ার হাওর ঘিরে রয়েছে ৮৮টি গ্রাম। অধিকাংশ গ্রামই হাওরবেষ্টিত। প্রতিটি গ্রামে আবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ও নেই। গ্রামগুলো ছোট হওয়ায় দুই-তিনটি গ্রাম নিয়ে এক একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে উচ্চশিক্ষার জন্য গ্রামগুলোতে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। দুই-একটি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান থাকলেও দূরত্বের কারণে ওইসব গ্রামের শিক্ষার্থীরা আর ভর্তি হয় না। বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলো থেকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থান অনেক দূরে। ফলে দুর্গম গ্রামের শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা শেষে উচ্চশিক্ষা নিতে আগ্রহী হয় না। বিশেষ করে মেয়েদের দুর্গম দূরের পথে পাঠাতে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। তবে যাদের সামর্থ্য আছে, তারা জেলা, উপজেলা বা বিভিন্ন স্থানে সন্তানদের ভর্তি করেন। এ কারণে মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে দেওয়া হয়। বাল্যবিয়ে কাগজে-কলমে বন্ধ থাকলেও ভুয়া কাগজ তৈরি করে এসব বিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। তাছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির আগে বহু শিক্ষার্থী ঝরে গেলেও এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে।

সরেজমিনে টাঙ্গুয়ার হাওরের কেন্দ্রে অবস্থিত গোলাবাড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের শামীম মিয়ার মেয়ে বিউটি বেগমের বিয়ের আয়োজন চলছে। দূর থেকে নিয়ে আসা হয়েছে সাউন্ড সিস্টেম। মেয়েটি জয়পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে আর মাধ্যমিকে ভর্তি হয়নি। আশপাশে কোনো স্কুল না থাকায় বাবা তাই অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলেন। 

শামীম মিয়া বলেন, ‘এওতা-বাইরায় আমরার দুর্ভোগ। হাইস্কুলে যাওয়া যায় না। হাইস্কুল দূরে থাকায় আমার মেয়েরে আর ভর্তি করি নাই। মেয়েদের বেশিদিন ঘরে রাখতে নাই। তাই তার বিয়ে দিয়া দিছি।’

এভাবে প্রতিবছরই হাওরের গ্রামগুলোতে বিউটির মতো অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়। উচ্চশিক্ষার পথ বন্ধ থাকায় এসব ঘটনা বেড়েই চলেছে বলে জানান এলাকাবাসী।

গোলাবাড়ি গ্রামের কিশোর মো. রফিকুল ইসলাম বলে, আমরার গ্রাম হাওরের মাঝখানো। হাইস্কুল ২-৩ কিলোমিটার দূরে। কোনোরকমে টাইন্যা-টুইন্যা আমরা প্রাইমারি পাশ করি। বাদে আর হাইস্কুলে যাই না। আমরা গেরামের মাত্র এক-দুইজন হাইস্কুলে-কলেজে পড়তে যায়। 

একই গ্রামের কিশোর সাব্বির আহমদ বলেন, কোনোমতে প্রাইমারি পড়তে পারে আমরার গেরামের ফুরুতাইন। পরে আর হাইস্কুলে যাইতে পারে না। আমরার গেরামের মানুষ অভাবী। পড়ার ব্যবস্থা নাই। মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়া দেওয়া হয়। ছেলেদের কাজে লাগানো হয়।

এই গ্রামের কৃষক খসরুল আলম বলেন, হেমন্তে হেঁটে এবং বর্ষায় নৌকা দিয়ে স্কুলে যেতে হয়। আবহাওয়া খারাপ থাকলে প্রাইমারি স্কুলেই শিক্ষার্থীরা যায় না। হাইস্কুলে তো এ কারণে ভর্তিই হয় না ৯৫ ভাগ ছাত্র-ছাত্রী। এ কারণে প্রতিবছর অল্প বয়সে ছেলে-মেয়েদের বিয়া দেওয়া হয়। পরিবারের লোকজন কাগজপত্র নানাভাবে ম্যানেজ করে নেয়।

তিনি বলেন, বর্ষায় স্কুলে যাওয়ার জন্য সরকারিভাবে যানবাহন দেওয়া হলে বা হাওরে আবাসিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হলে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী হবে শিক্ষার্থী ও অভিভাববকরা। 

জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শুধু টাঙ্গুয়ার হাওর নয়, হাওরের দুর্গম গ্রামগুলোতে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কম। সরকার দুর্গম এলাকার উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে আবাসিক ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন স্থানে স্কুল-কলেজ নির্মাণ হচ্ছে।


এসএস/আরআর-০৬