কমছে হাওরের গ্রামের আয়তন, এলাকা ছাড়ছে মানুষ

শামস শামীম, টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে এসে


আগস্ট ৩১, ২০২১
১১:০৮ অপরাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ৩১, ২০২১
১১:১৮ অপরাহ্ন



কমছে হাওরের গ্রামের আয়তন, এলাকা ছাড়ছে মানুষ
টাঙ্গুয়ার হাওরের নীরব কান্না (শেষ পর্ব)

বিপুল সম্পদের আধার ও অনন্য বৈশিষ্টের জলাভূমি হাওর। বছরের প্রায় ৯ মাস হাওর পানিতে ভর্তি থাকে। শীতকালে পানি কমলে লাগানো হয় বোরো ধান। একই সময়ে নিচু ভূমি হিসেবে পরিচিত জলাশয় থেকে আহরণ হয় মিঠাপানির নানা প্রজাতির মাছ। কিন্তু এই হাওর বর্ষায় আগ্রাসী হয়ে ওঠে। হাওরে সৃষ্ট আফাল (উত্তাল ঢেউ) ভেঙে দেয় গ্রামের পর গ্রাম। প্রতিবছরই আফালে কমছে হাওরের গ্রামের আয়তন। এতে নিম্ন আয়ের কৃষিজীবী পরিবারের লোকজন বসতবাড়ি রক্ষা করতে না পেরে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর বর্ষা শেষে শুকনো মৌসুমে ভেঙে যাওয়া ভিটায় আবার মাটি ফেলার সংগ্রাম হাওরবাসী করছে যুগ যুগ ধরে। এছাড়া সম্প্রতি টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকবাহী ইঞ্জিন নৌকার সৃষ্ট ঢেউয়ে বিভিন্ন গ্রামের ভিটা ভেঙে যাচ্ছে। দুর্গম হাওরের গ্রামগুলোকে প্রতিরক্ষা দেয়ালের আওতায় নিয়ে আসতে স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন ফোরামে দাবি জানিয়ে আসছেন ভুক্তভোগী মানুষজন।

হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের মতে দেশে ৪১৪টি এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতে দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ৭টি হাওর জেলায় প্রায় ৪২৩টি হাওর রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় দেড় শতাধিক হাওরের অবস্থান সুনামগঞ্জ জেলায়। দেশের হাওরগুলোর সম্মিলিত আয়তন প্রায় ৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার এবং এগুলো সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ৪৮টি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত। দেশের মোট আয়তনের ৬ ভাগের ১ ভাগ আয়তনের হাওরাঞ্চলে ২ কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস। প্রতিবছর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব জমা দিচ্ছে হাওর।

বর্ষায় হাওরগুলোতে উত্তরে অবস্থিত ভারতের মেঘালয় থেকে নেমে আসে পাহাড়ি ঢল। তখন ভয়ঙ্কর বন্যা দেখা দেয়। জলে ভরে যায় হাওর। এ সময় ঝড় এলে হাওরে আফাল ওঠে। সেই আফালের তাণ্ডবে সৃষ্ট ঢেউ আছড়ে পড়ে হাওরের গ্রামগুলোতে। গ্রামগুলোর চারদিকে হাওর থাকায় চারদিক থেকেই ঢেউয়ের শিকার হয় গ্রামগুলো। তীব্র ঢেউয়ে গ্রামগুলো ভাঙে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা হাওর থেকে কচুরিপানা, বিভিন্ন প্রজাতির বনসহ বাঁশ দিয়ে আড় বেঁধে ভিটা রক্ষা করেন। যাদের সেই সামর্থ্য নেই, তাদের ভিটা ভেঙে যায়। হেমন্ত মৌসুমে তারা আবার মাটি কেটে ভরাট করেন ভিটা। এভাবে যুগের পর যুগ ধরে তাদের ভিটা রক্ষার সংগ্রাম চলছে।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বিভিন্ন সময়ে দাতা সংস্থা ও এনজিওদের মাধ্যমে কিছু দুর্গম গ্রাম প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করে দেওয়ায় সেই গ্রামগুলো অরক্ষিত আছে। তবে দুর্গম হাওরের সবগুলো গ্রামেই প্রতিরক্ষা জরুরি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

টাঙ্গুয়ার হাওরের কেন্দ্রের গ্রাম গোলাবাড়ি। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা এখানেই নোঙর গেড়ে আনন্দ করেন। হেমন্তে হিজল-করচের বাগানের নিচে ক্যাম্প করে অবস্থান করলেও বর্ষায় লঞ্চ, স্পিডবোট, বাহারি নৌকাসহ ইঞ্জিনচালিত নানা ধরনের নৌকা নিয়ে তারা ভ্রমণ করেন। তখন ইঞ্জিনচালিত নৌযানের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ে গোলাবাড়ি, জয়পুর, ছিলাইন তাহিরপুর, মন্দিআতাসহ নিকটের গ্রামগুলোর বসতভিটা ভেঙে দেয় বলে জানান এলাকার লোকজন। এই আঘাতের কারণে প্রতিবছর ভাঙছে টাঙ্গুয়ার হাওরের গ্রামগুলো। তাই আয়তন কমছে গ্রামগুলোর। হাওরের আফালে সৃষ্ট ঢেউয়ের তাণ্ডবে ১৯৮৮ সালে তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের মারালা গ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী মদক গ্রামটিও বিলীন হয়ে গেছে। ফলে প্রতিবছর বিভিন্ন গ্রামের মানুষ বসতভিটা হারিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

গোলাবাড়ি গ্রামের আশি উর্ধ্ব প্রবীণ ব্যক্তি গোলাম মোস্তফা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, হেরা (পর্যটকরা) ঢাকা থাইক্যা আবার উল্টাবায় আইয়া টেকা-পয়সা রুজি কইরা যায়। আমরার ঘরবাড়ি ভাইঙা যায় ইঞ্জিনের ঢেউয়ে। আর আমরা দিন দিন গরিব অইতাছি। ভিটা আরাইয়া এলাকা ছাইড়া যাইতাছি।

তিনি জানান, টাঙ্গুয়ার হাওর রামসার সাইট ঘোষিত হওয়ার পরই পর্যটকদের মিছিল শুরু হয়। হেমন্তে এই মিছিলে গ্রামের কোনো ক্ষতি না হলেও বর্ষায় ইঞ্জিনচালিত যানবাহনের উত্তাল ঢেউ গ্রামগুলোতে আছড়ে পড়ে ভিটা ভেঙে নিচ্ছে।

শাল্লা উপজেলার বাহারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিধান চৌধুরী বলেন, প্রতি বর্ষায় শাল্লা উপজেলার প্রতিটি গ্রামেরই কিছু ঘরবাড়ি ঢেউয়ে ভাঙে। ভিটা হারিয়ে অনেক মানুষ আমাদের কাছে সাহায্য নিতে আসেন। কিন্তু এ খাতে কোনো বরাদ্দ না থাকায় আমরা কিছুই দিতে পারি না।

তিনি বলেন, হাওরের গাছপালা ও বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় আফাল এখন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। ঢেউয়ে ভাঙনও বেড়েছে।

ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইর রাজাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমানুর রাজা চৌধুরী বলেন, সাগরের ঢেউ এসে একদিকে লাগে। কিন্তু হাওরের গ্রামগুলোতে চারদিক থেকে ঢেউ আঘাত করে। যখন বর্ষায় ঝড় আসে, তখন ঢেউ আছড়ে পড়ে গ্রামগুলোতে আর ভাঙতে থাকে মানুষের ভিটা। গরিব মানুষ ভিটা হারিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যায়। 

তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণাসিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, বর্ষায় আফালের তাণ্ডবে গ্রামগুলোর ভিটা ভাঙার দৃশ্যটি করুণ। প্রতিবছর ভাঙতে ভাঙতে হাওরের গ্রামগুলোর আয়তন কমছে। আমি বিভিন্ন সভায় হাওরের সব গ্রামে প্রতিরক্ষা দেয়াল করার দাবি জানিয়ে আসছি।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, হাওরের গ্রামগুলোর কিছু ভিটা প্রতিবছর বর্ষায় ঢেউয়ে বিলীন হয়ে যায়। তখন হাওরের অন্যান্য গ্রামগুলোর বাড়িঘরও ঝুঁকির মুখে থাকে। গ্রামগুলো রক্ষায় তাই প্রতিরক্ষা দেয়াল করা জরুরি।

তিনি বলেন, ইতোপূর্বে স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে ও এনজিওর মাধ্যমে কিছু প্রতিরক্ষা দেয়াল দেওয়া হয়েছে। এখন স্থানীয় সরকারের ইএলজি প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা আরও কিছু প্রতিরক্ষা দেয়াল দেওয়ার চিন্তা করছি।


এসএস/আরআর-১২