চিকিৎসা সংকটে শান্তিগঞ্জের দুই লাখ মানুষ

সোহেল তালুকদার, শান্তিগঞ্জ


সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২১
১০:০২ অপরাহ্ন


আপডেট : সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২১
১০:৩৮ অপরাহ্ন



চিকিৎসা সংকটে শান্তিগঞ্জের দুই লাখ মানুষ
নির্মাণ হলেও চালু হয়নি ৫০ শয্যার হাসপাতাল

সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের ১৫৫টি গ্রামের প্রায় ২ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র ভরসাস্থল কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। উপজেলায় ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ করা হলেও সেখানে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে সেবা কার্যক্রম চালু হয়নি।

এদিকে, এটি উদ্বোধনের আগেই 'উড়ে এসে জুড়ে বসেছে' সুনামগঞ্জ বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজের অস্থায়ী ক্যাম্পাস। তাই উপজেলার মানুষজন এখনও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বড় বা জটিল কোনো রোগ হলেই যেতে হচ্ছে জেলা শহর সুনামগঞ্জ অথবা বিভাগীয় শহর সিলেটে। সেই সঙ্গে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য নেই কোনো আইসোলেশন সেন্টার বা চিকিৎসাকেন্দ্র। তবে করোনার নমুনা সংগ্রহ ও টিকাদান কার্যক্রম চলমান আছে। 

শান্তিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে ২০১৮ সালের ১০ জুন ২৮ কোটি ৩৯ লাখ ৫৪ হাজার টাকা ব্যয়ে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা হাসপাতাল ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এ নির্মাণকাজ ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি সম্পন্ন হলে চলতি বছরের ২৭ এপ্রিল সুনামগঞ্জ স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে হাসপাতালের ভবন হস্তান্তর করেন। কিন্তু জেলায় ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণাধীন থাকায় অস্থায়ী ক্যাম্পাস হিসেবে ব্যবহারের জন্য চলতি বছরের ১৮ মে স্বাস্থ্য বিভাগের কাছ থেকে ভবনটি নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে এখনও উপজেলার লোকজনের স্বাস্থ্যসেবার দ্বার উন্মোচন হয়নি। 

আরও জানা যায়, উপজেলায় ৭টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ২৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ২টি উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র চালু আছে। এগুলোতেই উপজেলার ২ লাখ মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চলমান আছে। সেই সঙ্গে এ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ১৯২টি ইপিআই টিকাদান কেন্দ্র আছে। সেখানে শিশুদের ১০টি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন টিকাদান নিশ্চিত করা হচ্ছে।

এদিকে, করোনা মহামারীর কারণে অনানুষ্ঠানিকভাবে সীমিত পরিসরে বর্তমান বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রশাসনিক কার্যক্রম, করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ ও করোনা প্রতিরোধে টিকাদান কার্যক্রম চলমান আছে। তবে হাসপাতালের বহির্বিভাগে কোনো রোগী দেখার সেবা চালু হয়নি।

উপজেলায় মোট ১১ জন এমবিবিএস চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র ৬ জন। এর মধ্যে করোনা মহামারীর কারণে উপজেলায় কোনো শয্যা না থাকায় জেলা সদর হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চলে গেছেন ৩ জন চিকিৎসক। বর্তমানে শান্তিগঞ্জ উপজেলায় আছেন মাত্র ৩ জন চিকিৎসক। নার্স থাকার কথা ১৩ জন, কিন্তু কর্মস্থলে আছেন ৪ জন। বাকি ৯টি পদ শূন্য রয়েছে। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত মিড ওয়াইফারি আছেন ৬ জন। ইউপিআই টিকাদান কেন্দ্রে ৩১ জন স্বাস্থ্য সহকারী থাকার কথা থাকলেও আছেন ১৭ জন।

উপজেলার দরগাপাশা ইউনিয়নের আমরিয়া গ্রামের জামাল উদ্দিন বলেন, উপজেলায় আমাদের হাসপাতাল চালু না হওয়ায় আমাদের কোনো কিছু হলেই সুনামগঞ্জে অথবা সিলেটে যেতে হয়। আমি ডায়রিয়া ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ৭ সপ্তাহ সিলেটের রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। এখন আমি সুস্থ আছি। আমাদের উপজেলায় হাসপাতাল চালু হলে তো আর সিলেটে যেতে হতো না।

উপজেলার আসামপুর গ্রামের আমজদ আলী বলেন, আমার স্ত্রীর গত শুক্রবার রাত ১১টায় প্রসবব্যথা শুরু হলে আমি মহাবিপদে পড়ে যাই। উপজেলায় কোনো হাসপাতাল না থাকায় রাত সাড়ে ১২টায় স্ত্রীকে নিয়ে ছাতক উপজেলার কৈতক হাসপাতালে যাই। সেখানেও চিকিৎসক না পেয়ে সিলেটের দিকে রওয়ানা হয়। কিছুদূর যাওয়ার পরে স্ত্রীর প্রসবব্যথা আরও তীব্র হয়। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের গোবিন্দগঞ্জ এলাকায় গাড়িতেই আমার স্ত্রীর সন্তান প্রসব হয়ে যায়। পরে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে ভোরবেলা বাড়িতে চলে আসি। 

শান্তিগঞ্জ উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জসিম উদ্দিন শরিফী বলেন, উপজেলার ৫০ শয্যা হাসপাতালটির কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করার প্রক্রিয়া চলছে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজের নিজস্ব ক্যাম্পাসের নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগের কাছ থেকে অস্থায়ীভাবে হাসপাতাল ভবনটি ক্যাম্পাস হিসেবে নেওয়া হয়েছে। দ্রুতই আমাদের হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম শুরু হবে। তবে এখনও লোকবল সংকট চরম আকারে আছে। মাত্র ৩ জন এমবিবিএস ডাক্তার ও ৪ জন নার্স এই উপজেলায় কর্মরত আছেন। 

তিনি আরও বলেন, আমাদের ৭টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে নিয়মিতভাবে রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা ও গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে এই ৭টি কেন্দ্রে ও ১০টি কমিউনিটি ক্লিনিকে গর্ভবতী মায়েদের ডেলিভারি কার্যক্রম চালু আছে। গ্রামের মানুষজন সহজেই হাতের কাছে এই সেবাটি পাচ্ছেন। তবে জটিল কোনো সমস্যা হলে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে রোগীদের স্থানান্তর করা হয়। ইতোমধ্যে আমি হাসপাতালটি দ্রুত আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পত্র প্রেরণ করেছি।


এসটি/আরআর-০২