মৌলভীবাজারে অবৈধ গাড়ি চলাচলে স্টিকার বাণিজ্য

মৌলভীবাজার প্রতিনিধি


অক্টোবর ০৫, ২০২১
০৪:৩৮ পূর্বাহ্ন


আপডেট : অক্টোবর ০৫, ২০২১
০৪:৩৮ পূর্বাহ্ন



মৌলভীবাজারে অবৈধ গাড়ি চলাচলে স্টিকার বাণিজ্য

গাড়ির বৈধ কাগজপত্র নেই কিংবা চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই এতে কোনো সমস্যা নেই। এসব গাড়ি অবাধেই চলছে মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন সড়কে। পুলিশও এদের আটকাচ্ছে না। কারণ একটাই এসব গাড়ি চলছে ‘বিশেষ স্টিকার’ লাগিয়ে। পুলিশ, শ্রমিক নেতা এবং অবৈধ যানবাহন বিক্রির সঙ্গে জড়িতরা অর্থের বিনিময়ে চালু করেছেন এই স্টিকার। মাস শেষে এই স্টিকার বাবদ বড় অংকের অর্থ আয় হয়। যার একটা অংশ পুলিশও পেয়ে থাকে। 

জানা গেছে, এসব স্টিাকার মাসোহারা ভিত্তিতে বিক্রি করা হয়। সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত টমটমে এসব স্টিকার বিক্রি করে মাসে প্রায় অর্ধকোটি টাকা আদায় করা হচ্ছে। গাড়ির লাইসেন্স থাকুক বা নাই থাকুক মাসোয়ারা স্টিকার থাকলেই গাড়ি রোডে চালানো যায়। এতে করে বাড়ছে যানজট ও দুর্ঘটনা। ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে পথচারীদের। জেলায় প্রতি মাসে দুর্ঘটনার ৭০ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশার কারণেই হয়ে থাকে। 

বিআরটিএ অফিস থেকে জানা যায়, জেলায় ২৪ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে কাগজ আপডেট আছে ১০ থেকে ১২ হাজারের মতো। এছাড়া ১ হাজার ৫’শ টমটমের রেজিস্ট্রেশন দিলেও এখন কোনোটারই কাগজ আপডেট নেই। রেজিস্ট্রেশনের বাহিরেও ৪ থেকে ৫ হাজার অনটেস্ট গাড়ি রয়েছে। লাইসেন্স না নিয়েও স্টিকার দিয়ে গাড়ি চালাতে পারায় বছরে কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, স্টিকারের আওতায় আনা হয়েছে জেলার প্রায় ১৫ হাজার সিএনজি, অটোরিক্সা ও টমটমকে। প্রতি মাসের ১ থেকে ৫ তারিখের মধ্যে গাড়ির সামনের গ্লাসে লাগাতে হয় সিএনজি শো-রুম, ট্রাফিক পুলিশ ও সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে সরবরাহকৃত নির্ধারিত মাসোয়ারা স্টিকার। 

স্টিকারে লেখা থাকে সাংকেতিক বিভিন্ন-স্লোগান। আবার কোনো কোনো শো-রুম মাসের নাম কিংবা নম্বর লিখে স্টিকার মাঠে ছাড়ে। ড্রাইভিং লাইসেন্স কিংবা গাড়ির কাগজ অনিয়মিত এবং সদর উপজেলার মধ্যে গাড়ি চললে ২’শ ৫০ টাকা এবং অনটেষ্ট ও পুরো জেলা হলে ১ হাজার টাকা মূল্যের স্টিকার কিনতে হয় ড্রাইভারদের। টমটমের জন্য ২’শ টাকার স্টিকার। 

সরেজমিনে দেখা যায়, মৌলভীবাজার সিএনজি অটো রিক্সা ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লি., মৌলভীবাজার সিএনজি ইউনিট কমিটি ও মক্কা-মদিনাসহ বিভিন্ন স্লোগান ও সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে গাড়ির সামনে স্টিকার লাগানো। হানিকম জাতীয় স্টিকার লাগানো হয় যাতে দূর থেকে কেউ এটা বুঝতে না পারেন। সেপ্টেম্বর মাসের স্লোগান ছিল ‘স্বাস্থ্য বিধি না মানলে মৃত্যু ঝুঁকি আছে’, ‘স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলুন নিরাপদে পথ চলুন’। 

এদিকে টমটমে রয়েছে চৌমুহনা অটো টমটম গ্রুপ পরিচালনা কমিটি, ডিবিবিএস, কেএস ও সিএস সহ একাধিক সংগঠন। ওই সকল স্ট্যান্ড থেকে স্টিকার সরবরাহ করা হয়। মাসের শুরুতে স্ট্যান্ডের দায়িত্বরত ব্যক্তির কাছে পৌঁছানো হয় স্টিকার। ড্রাইভাররা মাসের ১ থেকে ৫ তারিখের মধ্যে কিনে গাড়িতে লাগাতে হয়। অন্যথায় রোডে গাড়ি চালানো যায় না। পৌর শহরের মাছের আড়ৎ, ভুজবল, ভৈরববাজার, শ্রীমঙ্গল, শেরপুর, সরকারবাজার, খলিলপুর, ঘয়গড়, কাগাবালা, দিঘীরপাড়, আটঘর, বাহারমর্দন, মোহাম্মদপুর, সমসেরগঞ্জ, নতুনবাজার, রাজনগর, মুন্সিবারজার, টেংরাবাজার ও অফিসবাজারসহ একাধিক সিএনজি স্ট্যান্ড ঘুরে পরিচয় গোপন রেখে ড্রাইভার ও ম্যানেজারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রোডে স্টিকার ছাড়া কোনো গাড়ি চলাচল করলে ট্রাফিকের হয়রানির শিকার হতে হয়। স্টিকার থাকলে গাড়ির লাইসেন্স অথবা ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলেও আটকানো হয় না। 

শমশেরনগর স্ট্যান্ডের ড্রাইভার রাজা মিয়া বলেন, মাসের শুরুতে স্ট্যান্ডের সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ মিয়ার কাছ থেকে ২৫০ টাকার স্টিকার লাগাতে হয়। কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সিবাজার স্ট্যান্ডের ড্রাইভার হাসান বলেন, চৌমুহনী ট্রাফিক পুলিশের কাছ থেকে মাসের শুরুতে স্টিকার কিনে নেই। আগামী মাসের জন্য ৫টা স্টিকারের অর্ডার করেছি। 

শমশেরনগর রোডের মেসার্স এমএফ ফিলিং এন্ড সিএনজি ষ্টেশনে ১০ থেকে ১২ জন ড্রাইভারের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, স্টিকার ছাড়া কোনো সিএনজিচালিত অটোরিকশা রাস্তায় চালনো যায় না। যে অবস্থা শুরু হয়েছে কয়েকদিন পরে ড্রাইভিং ছেড়ে কৃষি কাজে লাগতে হবে। 

অভিযোগের বিষয়ে জেলা অটো টেম্পু, অটোরিক্সা, মিশুক ও সিএনজি পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি পাবেল মিয়া বলেন, স্টিকার দিয়ে গাড়ি চালানো যাবে এমন চুক্তি করে শো-রুমের মালিকরা অনটেষ্ট গাড়ি বিক্রি করে। নম্বর আছে এমন গাড়িতেও তো স্টিকার লাগাতে হয় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা আমিও শুনেছি কিন্তু আমার কোনো শ্রমিক আমাদের কাছে অভিযোগ করেনি। 

সিএনজি ব্যবসায়ী মালিক সমিতি সদর উপজেলা শাখার সভাপতি শেখ জহির আহমদ বলেন, আমরা কেবল গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্টিকার দেই। তাদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া হয়নি। ড্রাইভাররা বলে ১ হাজার টাকা দিয়ে আপনাদের কাছ থেকে স্টিকার কিনে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এগুলো আমরা এখন বাদ দিয়ে দিছি। 

এ বিষয়ে জেলা ট্রাফিক সার্জেন মোহাম্মদ উল্ল্যাহ বলেন, শো-রুমের লোক সিন্ডিকেট করে এ টাকা আদায় করে। 

জেলা পুলিশ সুপার মো. জাকারিয়া বলেন, স্টিকার বাণিজ্যের বিষয়টি নানা দিক থেকে আমার কাছেও এসেছে। ইতিমধ্যে কয়েকজন ট্রাফিক সদস্যকে বদলি করা হয়েছে। তদন্ত করে জড়িত ট্রাফিক সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে অনটেস্ট গাড়িগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলেই নানা দিক থেকে অনুরোধ আসে। নাগরিকদের সুবিধার কথা চিন্তা করে আমরা অনটেষ্ট গাড়ি চলার সুযোগ দিয়েছি। 

এসএইচ/আরসি-০১