স্বাধীনতার ৫০ বছরেও শনাক্ত হয়নি শহীদ ধ্রুবর সমাধিস্থল

আনোয়ার হোসেন মিঠু, নবীগঞ্জ


ডিসেম্বর ০৮, ২০২১
০৭:৪২ অপরাহ্ন


আপডেট : ডিসেম্বর ০৮, ২০২১
১০:০১ অপরাহ্ন



স্বাধীনতার ৫০ বছরেও শনাক্ত হয়নি শহীদ ধ্রুবর সমাধিস্থল

স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে গেলেও আজও নবীগঞ্জে  ধ্রুব’র সমাধিস্থল শনাক্ত হয়নি। এ নিয়ে চোখে পড়ার মতো কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধাদের মাঝেও তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়নি বলে জানান স্থানীয়রা।

গত ৪ ডিসেম্বর ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব’র শাহাদাত বরণের দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে নবীগঞ্জ শহরকে মুক্ত করতে পাক হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধে  হন এই বীর সেনা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও মহাবীর এই শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি কিংবা তার শাহাদাত বার্ষিকী পালন করতে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি। অযত্ন আর অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার শেষ স্মৃতি। 

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর সারাদেশের মতো নবীগঞ্জেও পাক হানাদার বাহিনীর হামলায় দিশেহারা অবস্থায় ছিলেন সাধারণ মানুষ। নবীগঞ্জ থানা প্রাঙ্গনে বাঙ্কার তৈরি করে রাজাকারদের সহায়তায় হানাদার বাহিনী শক্ত অবস্থান তৈরি করে বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এমন অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের আরেক সাহসী বীর সৈনিক আব্দুর রশীদ ও তার বাহিনী নবীগঞ্জ থানা প্রাঙ্গনে অবস্থিত হানাদারদের ক্যাম্পে হামলার সিদ্ধান্ত নেন। ওই দিন কাকডাকা ভোরে মুক্তিযোদ্ধা কনা মিয়ার বাড়ির পুকুর পাড়ে রশিদ বাহিনী নবীগঞ্জ থানায় অবস্থান করা পাক হানাদারদের ক্যাম্প টার্গেট করে অবস্থান নেয়। এই দলের সর্বকনিষ্ট সদস্য ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব। অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে পাক হানাদারদের বাঙ্কার ধ্বংস করতে গ্রেনেড হাতে ক্রলিং করে নবীগঞ্জ-বানিয়াচং সড়কের উপর দিয়ে অগ্রসর হতে থাকেন তিনি। তার সহযোদ্ধাগণ শক্র সৈন্যকে লক্ষ্য করে মেশিন গানের গুলি ছুড়তে থাকেন। পাক সেনারাও আক্রমণ প্রতিহত করতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকে। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা গুলি বিনময় হয়। হানাদার বাহিনীর তীব্র আক্রমনের সামনে টিকতে পারেননি মুক্তিযোদ্ধারা। সূর্যের আলো দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনী আত্মরক্ষার্থে পিছু হটতে থাকে। কিন্তু অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ধ্রæব’র আর পিছু হটা হলো না। পাক বাহিনীর ছুড়া গুলিতে তার বুকের পাজর ঝাঝরা হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই শাহাদাৎ বরণ করেন এই অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। 

সূত্র জানায়, দীর্ঘক্ষণ তার লাশ পড়ে থাকে নবীগঞ্জ-বানিয়াচং সড়কের রাস্তার উপর। এক সময় পার্শ্ববর্তী রাজনগর গ্রামের কিছু সাহসী যুবক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে  মুক্তিযোদ্ধা ধুব্র’র মরদেহ এনে সমাধিস্থ করেন নবীগঞ্জ-বানিয়াচং সড়কের রাজনগর গ্রামের এক কবর স্থানের পাশে। পরদিন ৫ই ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধা, তৎকালীন সাব-সেক্টর কমান্ডার মাহবুবুর রব সাদীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা নবীগঞ্জ থানা প্রাঙ্গনে অবস্থিত পাক হানাদারদের ক্যাম্পে আক্রমন করেন। মুক্ত করেন নবীগঞ্জ শহরকে। কিন্তু দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব’র সমাধিটি আজও সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। 

২৬ শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস, ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে ফুল দিয়ে সম্মান জানানো হয় মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীদের। কিন্তু ঠিকানা বিহীন মুক্তিযোদ্ধা  ধ্রুব’র সমাধিস্থল আজও অচিহ্নিত অবস্থায় নবীগঞ্জ থানা সংলগ্ন নবীগঞ্জ-বানিয়াচং সড়কের পাশে রাজনগর গ্রামের কবর স্থানের এক পাশে পড়ে আছে অযতœ আর অবহেলায়। একজন টগবগে যুবক ধ্রুব দেশ মার্তৃকার টানে অপরিণত বয়সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৫০ বছর পার হয়ে গেলেও তার সহযোদ্ধারা অনেক অনুসন্ধান করে তাঁর জন্মস্থান ও পিতামাতার সন্ধান পাননি। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার কোনো এক চা-বাগানের দরিদ্র শ্রমিক পিতা মাতার সন্তান ছিলেন  ধ্রুব। এক দিকে ঠিকানা বিহীন-অন্যদিকে সমাধি অচিহ্নিত, অবহেলিত এই কি ছিল  ধ্রুব'র স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ? আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের অনুসারী ও নবীগঞ্জের সচেতন নাগরিক সমাজ এই অবহেলিত  মুক্তিযোদ্ধার সমাধি চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। 

এ বিসয়ে নবীগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার নুর উদ্দিন (বীর প্রতীক) এর সঙ্গে মোবাইল ফোনে সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ ধ্রুব’র সমাধিস্থল চিহ্নিত করার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।’ চেষ্টা অব্যাহত আছে বলেও তিনি জানান।  

বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের দায়িত্বে থাকা নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মহিউদ্দিন এর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি জানান, তিনি এ উপজেলায় যোগদানের পর এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন জেলা প্রশাসক বরাবরে প্রেরণ করেছিলেন। 

তিনি মুক্তিযোদ্ধাসহ সকলের সহযোগিতা কামনা করে বলেন, ‘সকলে মিলে সহযোগিতা করলে অবশ্যই আমরা  ধ্রুব’র সমাধিস্থল চিহ্নিত করতে পারব।’  

বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার ক্ষমতায়। তাই অচিরেই  ধ্রুব’র সমাধিস্থল সনাক্ত করে সরকারিভাবে সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে প্রতি বছর শাহাদাৎ বার্ষিকী পালনের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন নবীগঞ্জের সচেতনমহল।

আরসি-০৫