স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি সিলেটে কতটা প্রতিষ্ঠিত তা ওই আঘাত না আসলে বুঝা যেত না

সঞ্জয় কুমার নাথ


এপ্রিল ০১, ২০২২
১১:৫১ অপরাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ০২, ২০২২
০৬:১৫ অপরাহ্ন



স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি সিলেটে কতটা প্রতিষ্ঠিত তা ওই আঘাত না আসলে বুঝা যেত না
-হাসান আরিফ

সিলেট মিরর কার্যালয়ে হাসান আরিফ। ছবি- সিলেট মিরর

...
বাংলাদেশের প্রথিতযশা বাচিক শিল্পী হাসান আরিফ। দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও অগ্রসৈনিক। সাংস্কৃতিক কাজে ঘুরে বেড়ান গোটা দেশ। আবৃত্তি চর্চার সঙ্গে শুদ্ধ জীবনের যে নিবিড় সম্পর্ক, তা তিনি লালন করেন সযত্নে। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে শিল্পকলার অন্যতম মাধ্যম, আবৃত্তি নিয়ে কাজ করছেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তিনি এক নির্ভীক যোদ্ধা। দেশের মানুষ আর ঐতিহ্যের মেলবন্ধন করা তাঁর ব্রত। বই পড়ুয়া মা রওশন আরা আর বাবা আবুল ফজল মো. মফিজুল হকের কাছেই তাঁর নন্দিত জীবনের হাতেখড়ি। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি এসেছিলেন সিলেট মিরর কার্যালয়ে। নগরে অতিথি হয়ে আমাদের সাংষ্কৃতি আন্দোলনের নানা দিক নিয়ে তখন কথা বলেছেন। 
প্রথিতযশা এই বাচিক শিল্পী আজ বেলা ১টার দিকে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাড়ি দিয়েছেন না ফেরার দেশে। গুণী এ শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সিলেট মিরর-এ প্রকাশিত তাঁর সাক্ষাৎকারটি আবারও প্রকাশ করা হলো।

...

সিলেট মিরর : সিলেটে প্রথম আসা এবং ওই সময়ে সিলেটের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কেমন দেখেছেন?

হাসান আরিফ : সবচেয়ে সহজ প্রশ্নের মধ্যে কঠিন অধ্যায় থাকে, এটা সেরকম প্রশ্ন আমার কাছে। আমি সিলেটে বহুবার এসেছি। তবে একদম নির্ধারণ করে বলতে পারব না আমি সিলেটে প্রথম কবে এসেছি।

আমার প্রথম সিলেট আসা সম্ভবত নব্বই দশকের শুরুর দিকে। সেই আসাটা একবারেই আবৃত্তির জন্য আসা। পরবর্তী সময়ে সাংস্কৃতিক জোটের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য আমাকে সিলেট আসতে হয়েছে। আবৃত্তি সংগঠনগুলোর আমন্ত্রণে বারবারই-তো আসছি। একটা কথা আমি বলতে পারি, সিলেটকে আমি দেখেছি নানাভাবে। তবে যতবারই এসেছি সাংস্কৃতিক কাজেই এসেছি। অনেকে হয়তো সিলেটে বেড়াতে এসে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দেখেছেন। আমি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এসে সিলেটকে দেখেছি ভিন্ন ভাবে। সিলেট বলতে আমি বৃহত্তর সিলেটের কথা বলছি। আমার প্রথম আসার সময় সিলেটে যে অবস্থাটা ছিল, আমার মনে হয়েছে, তখন একটি হিংস্র সাম্প্রদায়িক শক্তি উত্থানভূমি হিসেবে নিজেদের ঘোষণা দিতে চাইছে। আমি বলছি না যে, হয়েছে। আমি বলছি, চাইছে। একই সঙ্গে সিলেটের সর্বস্তরের মানুষ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। এই চমৎকার বিষয়টি কিন্তু আমি সব জায়গায় দেখি না। এই যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আপামর মানুষের লড়াই দেখেছিলাম, তখন থেকে সিলেটকে আমার জানা। এই জানাটা আমি এখনো মনোযোগে দেখছি। আমার নিবিড় পর্যবেক্ষনের আটাশ বছরের দেখা সিলেটকে যদি সাংস্কৃতিক দৃষ্টিতে দেখি, তাহলে সিলেট একটি অগ্রসরমান ভূমি। 


সিলেট মিরর : সংস্কৃতিকর্মীরা নানা সংগ্রামে রাস্তায় নামেন। সিলেটের ক্ষেত্রে আপনার মূল্যায়ন কী?

হাসান আরিফ : সিলেটের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এখানে সংস্কৃতিকর্মীরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে একাকিত্বে ভোগেন না। সর্বস্তরের মানুষ তাদের সঙ্গে থাকেন। দেশের অনেক জায়গায়ই এ বিষয়টি নেই। রাজনীতিবিদ বা সমাজপতিরা কেউ তাদের দিকে হাত বাড়ায় না। তাদের লড়াই টা তাদেরই করতে হয়। সিলেটে তাদের (সংস্কৃতিকর্মীদের) লড়াই কেবল তাদের নয়। অনেক সময় দূর থেকেও স্পষ্ট করে দেখা যায়। কাছে থেকেও স্পষ্ট করে দেখা যায় না। ধরুন, গণ জাগরণ মঞ্চ কোথায় কোন পথে যাবে, সেটার ওপর নির্ভর করেনি, সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের গঠন বা এর গতিপ্রকৃতি। সে একটা ডাক পেয়েছে। সে ডাকটা সে শুনেছে। নিজের ভূমিতে সে দাঁড়িয়েছে। কারণ তাকে তো প্রতিনিয়ত শক্ত প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তার ভূমিতে। এবং লড়াইটা সিলেটের অন্য জায়গার থেকে অন্য রকম। ‘গণজাগরণের কালে’ এই হিংস্র গোষ্ঠী সিদ্ধান্ত নিল রাজনৈতিক লড়াইয়ের এটা একটা চুড়ান্ত সময়। শহীদ মিনারকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা, বাংলাদেশের সর্বত্র হয়নি কিন্তু। আবার আগুনটা নিভতে নিভতে, একটা শহীদ মিনার ভালোভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়ার নজির সকল জনপদে দেখতে পাওয়া যায় না। যেখানে বিরুদ্ধ শক্তি নিজেকে অনেক শক্তিশালী ভাবে, সেখানে তার পাল্টা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি যে কতটা প্রতিষ্ঠিত এটা সিলেটে ওই আঘাতটা না আসলে আমরা বুঝতে পারতাম না। একেবারে সহজ কথায় হযরত শাহজালাল (রহ.) ও শাহপরাণ (রহ.) এর মাজার রয়েছে এখানে। অনেকে ভাববে এটা তো মাজারের শহর। কিন্তু তারা হয়ত জানেইনা যে, এই দুই আউলিয়াই সংস্কৃতিকর্মীদের মূল শক্তি। তাই এখানে লড়াইটা ভিন্নতর। একই সঙ্গে এখানে রয়েছে, হাজার বছরের ভাটির সংস্কৃতি এবং ভাটির সংস্কৃতির ঐতিহ্য। এ বিষয়টি প্রতিপক্ষ ভুলে যায়। এখানে সকল বয়সের মানুষ যখন মিলে বিয়ের অনুষ্ঠানে রাতবিরাতে আনন্দের সঙ্গে ধামাইল গান করে। এই সাংস্কৃতিক বন্ধনটি খুবই গভীরে প্রোথিত। এর মধ্যে দিয়েই সিলেটের মানুষ চলে, বাঁচে। যার কারণে এখানকার সাংস্কৃতিক ধারার প্রবহমানতা রুখতে পারবে না কেউ। তাই মাঝে মাঝে মনে হয়, এরকম আঘাত আসা ভালো। কারণ লোহাতে জং ধরলে সেটা পরিস্কার করে ফেললে লোহার শক্তি আরো বেড়ে যায়। আমাদের দেশের কয়েকটি অঞ্চলকে আমি বিশেষভাবে চিহ্নিত করি। যারা বাঙালি সংস্কৃতিকে অন্যভাবে অলংকৃত করেছে। ভাটিবাংলার বিরাট এলাকা জুড়ে এ সিলেটে অসম্ভব একটা সৌন্দর্য আছে। এখানকার সুন্দর প্রকৃতির সঙ্গেই মিলে রয়েছে সুফিবাদ। সিলেটের গান ও সুর একেবারে আলাদা একটা ভালোলাগার বিষয়। এটা সব জায়গায় পাওয়া যাবে না। আমি হয়ত এ বিষয়টি কুষ্টিয়া অঞ্চলে পাবো। খেয়াল করে দেখেন, সেখানে মীর মশাররফ হোসেন বিষাদসিন্ধু রচনা করেছেন। কাঙাল হরিনাথ বা লালল শাহ যে গান রচনা করেছেন, তা একই সূত্রে গাঁথা। সুফিবাদ বাউলদের হাত ধরে অন্য একটি মাত্রা পায়। সিলেট ও কুষ্টিয়া অঞ্চলে এ বিষয়টি আমাকে ভাবায়।



সিলেট মিরর : সিলেটের অন্য কোন বিষয়টি আপনার কাছে আলাদা করে ধরা দেয়? 

হাসান আরিফ : সিলেট অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাসে বৈচিত্র্য আছে। যেমন রোজার ইফতারিতে ‘ছানাবুট’ কিংবা সুস্বাদু খিচুড়ি খাওয়া হয় । সিলেটের বিন্নিভাতের (বিরনভাত) স্বাদ তো আলাদাই। অথবা ধরেন, সাতকরা দিয়ে মাছ বা মাংস রান্না করা, এসব সিলেটের নিজস্ব ঐতিহ্য। আমি মনে করি, আধুনিকতার নামে যেন তা উঠে না যায়। আমি এটাকে বাঁচিয়ে রাখার পক্ষে। এটাকে প্রবলভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এটা নিজেকে (সিলেট) দেখার গৌরব।


সিলেট মিরর : সিলেটের প্রকৃতি ও গান সম্পর্কে শুনতে চাই 

হাসান আরিফ : সিলেট অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ধরেন একজন নির্মলেন্দু চৌধুরী ও হেমাঙ্গ বিশ্বাসের চলে যাওয়া অনেক বড় একটা কষ্টের বিষয় ছিল। অনেক বড় একটা ধাক্কা ছিল। তাঁদের অভাব পূরণ আর হবে কি না এরকম একটা আশংকা ছিল। আবার ধরেন শাহ আবদুল করিমের আবির্ভাব সিলেটের গানকে পুণরায় উজ্জীবীত করে। আবার সিলেট মানে হচ্ছে রাতারগুল, জাফলং, বিছনাকান্দি, মাধবকুণ্ডসহ প্রকৃতির অপরূপ লীলাভ‚মি। এটা আমি আজকে নতুন করে দেখছি না। আমি তা জানি হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কষ্ট থেকেই। ওই যে মনে গেঁথে আছে, ‘ হবিগঞ্জের জ্বালালি কৈতর/ সুনামগঞ্জের কুড়া/ সুরমা নদীর গাঙচিল/ আমি শূন্যে দিলাম উড়া/ শূন্যে দিলাম উড়ারে ভাই/ যাইতে চান্দের চর/ ডানা ভাঙিয়া পড়লামরে ভাই কলকাতার উপর/। অর্থাৎ আমার আকাঙ্খাই ছিল না কলককাতা নগরে পড়ার। আমি দুর্বিপাকে পড়ে, আমার ভূমি ছেড়ে কলকাতায় আসতে হয়েছে। আমরা অনুভব করি, একজন শিল্পীর আকুতি। এই সিলেট ছেড়ে চলে যেতে হলে, সে আর অন্যকোনো ভূমিতে যেতে চায় না। মানুষই থাকতে চায় না। পাখি হয়ে উড়ে চান্দের দেশে চলে যেতে চায়। শিল্প সংস্কৃতির শহর কলকাতাও তাঁর কাছে তখন আকর্ষনীয় মনে হয় না। আমি এই জায়গাটিতে নক করতে চাই। সিলেটের মানুষের কাছে তাঁর জনপদ কত আকাঙ্খিত! আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করি


সিলেট মিরর : সিলেটে যারা আবৃত্তি করতে চান, তাদের প্রতি বিশেষ কোন  কথাটি বলবেন? 

হাসান আরিফ : মান (প্রমিত) ভাষায় কথা বলতে হবে, জানতে হবে। কিন্তু নিজের ভাষা ছেড়ে নয়। আমি আবৃত্তি শিল্পী বা বাচিক শিল্পী হিসেবে খুব পরিস্কার করে বলছি, জীবনের প্রয়োজনে মান ভাষা অধিকারে থাকতে হবে ঠিক, তবে অতি মায়ার নাড়ীর সঙ্গে যুক্ত যে আঞ্চলিক ভাষা তা ধরে রাখতে হবে। একটা উদাহরণ দিই। আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চমৎকার প্রমিত উচ্চারণে কথা বলেন। আমি জেনেছি, কিন্তু তিনি বাড়িতে (সিলেটের বাসায়) এলে সিলেটের ভাষায়-ই কথা বলেন। তাই আমার কথা হলো, সর্বতভাবে নিজের শেকড়কে লালন করতে হবে। সংস্কৃতি চর্চায় নিজের আঞ্চলিক ভাষাও যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে। এখন হয়েছে উল্টো। আমরা মানভাষা রপ্ত করি, কিন্তু নিজের আঞ্চলিক ভাষার সঠিক প্রয়োগ করি না। এটা ঠিক নয়। তাই আমি বলি, একজন মানুষ যেমন তাঁর মায়ের ভাষায় (আঞ্চলিক) শুদ্ধ, তেমনি শুদ্ধ তাঁর রাষ্ট্রীয় ভাষায়। তবে উভয় ক্ষেত্রেই যত্নবান হতে হবে।

আমি খুব আনন্দের সঙ্গে বলছি, সিলেটে নতুন প্রজন্মের আবৃত্তি চর্চার আগ্রহ এবং তাদের পারদর্শিতা আমাকে মুগ্ধ করে। বাচিক শিল্পে সিলেটের সম্ভাবনা উজ্জ্বল।


এএফ/০৩