জাকাত ও ফিতরার বিধান

সৈয়দ মবনু


মে ০১, ২০২২
০৮:০৯ অপরাহ্ন


আপডেট : মে ০১, ২০২২
০৮:০৯ অপরাহ্ন



জাকাত ও ফিতরার বিধান

জাকাত হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত-ধনীর সম্পদে গরিবের অধিকার। এই অধিকার আদায়কালে আদায়কারি হক্বদারকে সম্পদের পূর্ণাঙ্গ মালিকত্ব দিয়ে দিতে হয়। কাজের বিনিময় কিংবা অনুগ্রহ আর দয়া-মায়ায় এই দান করলে হবে না। দান করতে হবে জাকাতের নিয়তে এবং জাকাতের নিয়মে। যিনি জাকাত দিবেন তার পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাস থাকতে হবে আমি যা দিচ্ছি তা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত গরিবের হক। যাকে দেওয়া হবে সে এই মাল স্বাধীনভাবে খরচের অধিকার পাবে। যদি আদায়কারি কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করেন তবে জাকাত আদায় হবে না। নির্বাচন কিংবা দানবীর প্রচারের উদ্দেশ্যে যদি কেউ জাকাত দেন তবে তা আদায় না হয়ে বরং পাপ হবে। জাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে যদি সামান্যও আমিত্ব কাজ করে তবে তাতে পাপ অবশ্যই হবে।

যে সকল বস্তু থাকলে জাকাত ফরজ হয় 

ইসলামি শরিয়তে চার প্রকার বস্তুর ওপর জাকাত ফরজ করা হয়েছে-১) স্বর্ণ-রৌপ্য, ২) ব্যবসার মাল, ৩) চতুস্পদ জন্তু, ৪) কৃষি উৎপাদনের ওপর।

এখানে উল্লেখ্য যে, কৃষি উৎপাদনের ওপর যে হিসাব তা জাকাত থেকে একটু ভিন্ন। তাই এটাকে জাকাত না বলে শরিয়তে তাকে ‘উশর’ বলা হয়। উশরের হিসাব হলো উৎপাদনের দশ ভাগের এক ভাগ। 

জাকাত না দিলে 

জাকাত দেয়ার মতো মাল থাকার পরও জাকাত না দিলে এই ব্যক্তি ফাসেক হিসেবে চিহ্নিত হবে। এই রকমের ব্যক্তির প্রতি ইসলাম এবং মুসলমানের কোন দায়-দায়িত্ব নেই। ইসলামি রাষ্ট্র থাকলে তাদেরকে শাস্তি দেয়ার বিধান রয়েছে এবং রাষ্ট্র ওদের কোন নিরাপত্তা দিতে বাধ্য নয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- ‘যদি তারা তাওবাহ করে আর নামাজ কায়েম করে এবং জাকাত আদায় করে তা’হলে তাদের রাস্তা বন্ধ করবে না, তাদেরকে কষ্ট দেবে না। (সুরা তাওবাহ)। এই আয়াত থেকে স্পষ্ট যে গরিবের হক জাকাত আদায় করে না তার রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে তাকে কষ্ট দেয়া বৈধ আছে। এই আয়াত আমাদেরকে শোষক এবং পূঁজিবাদিদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিচ্ছে। হযরত ওমর বিন খাত্তাব (র.) জাকাত অনাদায়কারিদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। পবিত্র কোরআনের অন্য আয়াতে রয়েছে-‘যদি তারা তাওবা করে, নামাজ কায়েম করে এবং জাকাত দেয় তবে তারা তোমাদের ভাই। (সুরা তাওবাহ) অর্থাৎ যারা জাকাত দেয় না তাদের সাথে মুসলমানদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। 

প্রসঙ্গ: জাকাত আর জিজিয়া 

অনেকে জিজিয়াকে অমুসলিমদের ওপর জুলুম বলে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করে থাকেন। প্রকৃত অর্থে জাকাত আর জিজিয়ার বিধান চিন্তা করলে একই। আমরা জানি যে, জাকাত শুধু মুসলমানদের ওপর ফরজ। ইসলামি রাষ্ট্রে জাকাত আদায়কারির জান, মাল, ইজ্জতের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিবে রাষ্ট্র। এক্ষেত্রে জাকাত আদায় করবে রাষ্ট্র। ইসলামি রাষ্ট্রে জাকাত আদায়কারির মালের ওপর অন্য কোন রাষ্ট্রীয় টেক্স আসবে না। এখন কথা হÑইসলামি রাষ্ট্রে যারা অমুসলিম হবে তাদেরতো জাকাত-ফেতরা নেই, তা হলে তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কি রাষ্ট্র নেবে না? অবশ্যই নেবে। বিনিময়ে তারা জিজিয়া টেক্স দিবেন। এক্ষেত্রে বিধান হলোÑযদি রাষ্ট্র জিজিয়া টেক্স আদায়করি কোন নাগরিকের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় তবে অবশ্যই তার জিজিয়ার টাকা ফেরত দিতে হবে। জিজিয়া টেক্স নিয়ে অজ্ঞতা বশত অনেকে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করেন। এই বিষয়টি শরিয়তে এতই স্পষ্ট রয়েছে যে, বিভ্রান্তির কোন সুযোগ নেই। জিজিয়া টেক্সের ওপর নাম অমুসলিমদের নিরাপত্তা টেক্স। মুসলমানরা জাকাত দেয়, অমুসলিমরা জিজিয়া দেয়-এই হলো ব্যবধান।


জাকাতের তাৎপর্য 

পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহপাকের ঘোষণা হলোÑ‘ যে নামাজ কায়েম করে, জাকাত আদায় করে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অনুসরণ করে অতি নিকটবর্তি আল্লাহ তার ওপর দয়াবান হবেন।’ (সুরা  তাওবাহ)। অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে-‘হে নবি, আপনি তাদের মাল থেকে সদকা আদায় করুন যা দ্বারা তাদেরকে গোনাহ থেকে পবিত্র ও পরিস্কার করা হয়।’ ( সুরা তাওবাহ) 

ফেতরা 

ফিতরাকে বলা হয় রোজার জাকাত। জাকাত যেমন মালকে পবিত্র করে তেমনি ফেতরাও রোজাকে পবিত্র করে, অর্থাৎ রোজা রেখে যে ভুল-ত্রæটি হয় তা ফেতরার মাধ্যমে পূরণ হয়ে মকবুলিয়তের কারণ হয়ে যায়। ইমামে আজম আবু হানিফা (র.) এর মতেÑযাদের এমন মাল আছে যে ঘরের প্রয়োজন মিটিয়ে অতিরিক্ত থাকে তার ওপর ফেতরা ওয়াজিব। ফেতরা দিতে হয় নিজের পক্ষ থেকে এবং পৌষ্যের পক্ষ থেকে। ফেতরার জন্য মালের এক বছর হওয়া জরুরী নয়। ঈদের দিন জামাতের পূর্বে ফেতরা আদায় করা উত্তম। ইমাম আবু হানিফা (র.)এর মতে ফেতরার পরিমাণ হলোÑগমের অর্ধ ছা’য়া বা এক সের বারো ছটাক। অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের পূর্ণ এক ছা’য়া বা তিন সের নয় ছটাক। নাবালেগের ফেতরা তার অভিবাবকের পক্ষ থেকে দিতে হয়। জাকাত যাদের দেয়া যায় ফেতরাও তাদেরকে দেয়া যায়। বিশিষ্টি সাহাবী হযরত আব্দুল¬াহ ইবনে ওমর (রা.) বলেনÑ‘ মুসলমান ক্রিতদাস ও আজাদ, নারীÑপুরুষ, ছোটÑবড় সবার ওপর হযরত নবি করিম (স.) সদকায়ে ফেতর এক ছা’য়া খেজুর বা যব নির্ধারণ করেছেন। মানুষ ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।’ (মুত্তাফেকুন আলাইহে)।

জাকাত কাকে দেওয়া যাবে 

হযরত নবী করিম (স.) বলেন, জাকাতের মাল বন্টনের বিধান তৈরির ক্ষমতা আল্লাহপাক কোন নবী বা অন্য কাউকে না দিয়ে নিজেই তৈরি করে দিয়েছেন। (সুনানে আবু দাউদ)।    

মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন, সাদকা তো কেবল ফকির, মিসকিন এবং জাকাত সংগ্রহকারী কর্মচারীদের জন্য, যাদেরকে ইসলামের দিকে আকর্ষন করার উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্থদের জন্য, আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী মুজাহিদদের জন্য, মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সুরা তাওবাহ : ৬০)। 

ইসলামে সাদকা বলা হয় জাকাত, ফিতরা এবং মান্নতের মাল ইত্যাদিকে। এই আয়াত থেকে স্পষ্ট আট শ্রেণীর মানুষকে সাদকা দেওয়া জায়েজ। তবে প্রশ্ন হলো জাকাত কি আটশ্রেণীকেই দিতে হবে না যে কোন এক শ্রেণীকে দিলেই জাকাত আদায় হবে? হযরত ইমাম শাফি (র.) প্রমূখের মতে আটশ্রেণীকে জাকাত দেওয়া ওয়াজিব। আর হযরত ওমর (র.) হযরত হুযায়ফা (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (র.) প্রমূখের সূত্রে ইমাম মালেক প্রমূখরা বলেন, সকল শ্রেণীকে দান করা ওয়াজিব নয়। যে কোন এক শ্রেণীকে দিলেই আদায় হয়ে যাবে। (তাফসীরে ইবনে কাসির, চতুর্থ খন্ড, সুরা তাওবাহ)। ইমাম আবু হানিফা (র.)-এরও এই মত যে, সবাইকে দিতে হবে না। ইমাম ইবনে জরির (র.) লিখেছেন, সবাইকে দিতে হবে না, এই আটশ্রেণীর মধ্যে যেকোন এক শ্রেণীকে দিলেই জাকাত আদায় হবে, তা অধিকাংশ ফকিহর মত। 

১. ফকির কাকে বলে? 

আমরা সাধারণত বাঙালিরা ফকির মনে করি ভিক্ষুককে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আল্লাহ ফকির শব্দ দিয়ে কি তা বুঝিয়েছেন? কোরআন বিশেষজ্ঞদের মতে না, এখানে ফকির এসেছে ‘গরীব’ অর্থে। ইসলামের দৃষ্টিতে গরীব হলো তারা যাদের ধন-সম্পদ আছে, তবে তা দিয়ে প্রয়োজন পূরণ হয় না। সহজ করে বললে বলতে হয়; যারা জাকাত দেওয়ার মতো মালের অধিকারী নয়।

২. মিসকিন কাকে বলে? 

যারা নি:স্ব, খাদ্য যোগার করতে পারে না এবং অভাব থাকার পরও অন্যের কাছে চাইতে পারে না। কাজে সক্ষম হওয়ার পরও যদি কেউ কর্ম সংস্থানের অভাবে বেকার থাকতে বাধ্য হয় এবং মানবেতর জীবন-যাপন করে তবে হযরত উমর (রা.) তাকে মিসকিন মনে করতেন।

৩. জাকাত সংগ্রহকারী কর্মচারী 

‘আমিলুন’ দিয়ে জাকাত সংগ্রহকারী কর্মচারীদের কথা বুঝানো হয়েছে। যাদেরকে ইসলামী রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জাকাত আদায়, বিতরণ, হিসাব সংরক্ষণ ইত্যাদির জন্য নিয়োগ করা হবে তাদের বেতন জাকাতের তাহবিল থেকে দেওয়া যাবে। 

৪. ‘মুয়াল্লাফাতিল কুলুব’

মহান আল্লাহ পাক যাদেরকে জাকাত দিতে বলেছেন তাদের মধ্যে এক শ্রেণী হলেন ‘মুয়াল্লাফাতিল কুলুব’ অর্থাৎ যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য। ‘মুয়াল্লাফাতিল কুলুব’-এর ব্যাখ্যায় বিভিন্ন মুফাস্সিরদের আলোচনা থেকে জানা যায়, যাদেরকে জাকাত দিলে তাদের অন্তরে মুসলমান বা ইসলামের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হবে। 

৫. ঋণগ্রস্থের জন্য

সাদকা দানের বিধান সম্পর্কিত আয়াতে ষষ্ঠশ্রেণী বলা হয়েছে ‘গারিমিন’ অর্থাৎ ঋণগ্রস্থের জন্য। যারা ঋণগ্রস্থ হয়েগেছেন তাদেরকে ঋণমুক্ত করতে সাদকার মাল দান করা যায়। তবে অনেক ফকিহ বলেছেন, যে তার ঋণ হতে হবে বৈধ কারণে। কেউ যদি অবৈধ বা পাপ কাজের কারণে ঋণগ্রস্থ হয় তবে তাকে সাদকার মাল দান করা যাবে না। (মুফতি শফি র., তাফসীরে মাআরিফুল কোরআন, পৃ. ৫৭৯)।  

৬. আল্লাহর পথে জিহাদকারি 

সাদকা দানের বিধান সম্পর্কিত আয়াতে সপ্তমশ্রেণী বলা হয়েছে ‘ফি সাবিলিল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর পথে যারা। আল্লাহর পথে কথাটি অনেক ব্যাপক। মুফাস্সির এবং ফকিহদের মতে এখানে ব্যাপক অর্থে আল্লাহর পথে হবে না, হবে মূলত যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে তাদের কথা। অবশ্য হযরত ইমাম আহমদ, হাসান বসরী এবং ইমাম ইসহাক (র.) বলেছেন, দরিদ্র এবং অভাবী হজ্বযাত্রিও আল্লাহর পথে জিহাদকারীর মতো ‘ফি সাবিলিল্লাহ’-এর অন্তর্ভূক্ত। (তাফসীরে ইবনে কাসির)

৭. মুসাফির 

মুসাফির বলা হয় যে ব্যক্তি তার বাড়ী থেকে ৪৮ মাইল দূরে সফর করেছে। সে বাড়ীতে যত বড় ধনীই হোক না কেন যদি সে সফররত অবস্থায় অভাবগ্রস্থ হয় তবে তাকে সাদকার মাল থেকে দান করা হালাল। আবার কোন অভাবগ্রস্থ লোক নিজ বাড়ী থেকে কোথাও যেতে চাইলে তাকে যাতায়াতের জন্য সাদকা থেকে প্রয়োজনীয় মাল দান করা যাবে।

মহান আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর বিধান অনুযায়ি জাকাত আদায়ের তৌফিক দান করুন।


সৈয়দ মবনু :  কবি ও গবেষক


এএফ/০৬