চা শ্রমিকদের বৃত্তাবদ্ধ জীবন

নিজস্ব প্রতিবেদক


জুন ০৪, ২০২২
০১:৫০ অপরাহ্ন


আপডেট : জুন ০৪, ২০২২
০১:৫৯ অপরাহ্ন



চা শ্রমিকদের বৃত্তাবদ্ধ জীবন

‘পড়ালেখা না করলে তো ভবিষ্যতে রুটি-রুজির পথ বন্ধ। তাই ছেলে-মেয়ে দুই জনকেই পড়াশোনা করাব। মেয়েকে আপাতত মেট্রিক পাস করানোই আমার লক্ষ্য। তারপরের ধাপের চিন্তা পরে করে নেব। তবে ছেলেকে নিয়ে আমার স্বপ্নটা অনেক। ছেলেকে ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্ন দেখি।’ কথাগুলো বলছিলেন লক্ষ্মীছড়া চা বাগানের শ্রমিক বিনয় বাত্বি (৩২)।

ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে এই স্বপ্ন দেখেন তিনি। তার এই স্বপ্নের কথা শুনলে যে কোনো মানুষের চোখে খুশির ঝিলিক খেলবে। কিন্তু মেয়েকে মেট্রিক পাস করানো পর্যন্তই! এতোটুকু শুনলে হয়তো অনেকেই বুঝে নেবেন যে মেয়েদের থেকে ছেলেদেরকেই বেশি তাদের সমাজেও প্রাধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু যখন বিনয় বাত্বির কাছে জানতে চাওয়া হলো কিসের ইঞ্জিনিয়ার? উত্তরে সে জানালো, ‘ওই যে গ্যারেজ আছে না, সেখানে গাড়ির ইঞ্জিনিয়ার।’

শুধু বিনয়ই না, এই লক্ষ্মীছড়া চা বাগানের শ্রমিকরাই না, বিনয়ের মতো আরও কত শ্রমিক আছে বিভিন্ন চা বাগানে, যাদের কাছে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে তাদের কাছে সেই একই উত্তর পাওয়া যায়। তাদের সাথে কথা বললে এইটুকু বোঝা গেল যে তাদের মাঝে নূন্যতম শিক্ষার আলো হলেও পৌঁছেছে। তবে শিক্ষার আলো পৌঁছালেও, তাদের চিন্তাধারার দূরত্বটা চার দেয়ালের মতো সবুজ অরণ্যে ঘিরে রাখা চা বাগান থেকে এখনও বেড় করে নিয়ে আসতে পারেনি।

এই গাড়ির গ্যারেজে যেটাকে বিনয়ের মতো লোকেরা ইঞ্জিনিয়ার বলে জানে, সেটাকেই আমরা অনেক ম্যাকানিক বলে ডাকি। কোনো কাজকেই ছোট করে দেখার কিছু নেই। প্রত্যেকটা কাজই মহৎ। তবে আমাদের সমাজের চিন্তাধারা থেকে যদি বলা হয় তবে কাজে নামার আগে কাজের স্বপ্ন দেখাটাই মুখ্য। স্বপ্ন থাকতে হয় অনেক বড়। কিন্তু তাদের স্বপ্নটা যে জায়গায় সীমাবদ্ধ সেটাই প্রমাণিত করে যে চা শ্রমিকদের চিন্তাধারার উন্নতিটা এখনও হয়নি।

‘ইঞ্জিনিয়ার’ এই পেশার প্রতি চা শ্রমিকদের কাছে এতো আকর্ষণ কেন জানতে চাইলে মালনীছড়ার হিলুয়াছড়া চা বাগানের প্রাক্তন সহকারী ব্যবস্থাপক আতিক ইসর বলেন, ‘প্রত্যেকটি চা বাগানের ফ্যাক্টরি এবং চা পাতা বহন করার জন্য বেশ কয়েকটি গাড়ি থাকে। এই গাড়িগুলো মেরামত যারা করে তাদের মজুরি অন্যসব চা শ্রমিকদের থেকে একটু বেশি। এজন্য এই পেশার প্রতি তাদের আকর্ষণ বেশি।’ তাছাড়া এই গাড়ি মেরামত পেশাটাকে হয়তো সম্মানজনকভাবে দেখে থাকতে পারে চা শ্রমিকরা, এমনটি মনে করেন তিনি।

চায়ের ইতিহাস অনেক পুরোনো হলেও বাংলাদেশে এর আবির্ভাব ঘটে ১৮ এর শতকে। বৃটিশরা ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল যে এদেশের মানুষকে দিয়ে এই জঙ্গল পরিষ্কার করে চা বাগান তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই ‘মাটি খুড়লে স্বর্ণ পাওয়া যায়’ এমন প্রলোভন দেখিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে লোকজন নিয়ে আসে বৃটিশরা। বাংলাদেশের প্রথম চা বাগান মালনীছড়া চা বাগান। এই বাগানের মাধ্যমেই এদেশে প্রথম শুরু হয় চা শিল্পের।

তেলিহাটি চা বাগানের নারী শ্রমিক প্রেমিল বাউড়ি (৮০)। স্বামীর নাম জানতে চাইলে তিনি জানালেন ‘তেনার নাম মুখে লিতে নেই বাবু।’ যদিও তার ছেলে দয়াল বাউরির কাছ থেকে জানা গেল নাম। বীরেন্দ্র বাউরি। যিনি গত হয়েছেন আরও কয়েক বছর আগেই।

প্রেমিল বাউরিদের পূর্বের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইলে শোনান সেই গল্প। সেই গল্পগুলোও তিনি শুনেছেন তার দাদা-দাদীদের কাছ থেকে। প্রেমিলদের আদি বাসস্থান পশ্চিম ভঙ্গের মেদিনীপুর বিভাগের বাঁকুড়া জেলার কুমকা গ্রামে। সেই সময়ে অনেক কষ্টে তাদেরকে দিন কাটাতে হতো। অনেক সময় অনাহারেই অতিবাহিত হতো দিন। একদিন সাহেবরা গেল তাদের গ্রামে। বলল এমন একটা জায়গা আছে যেখানে মাটি খুঁড়লে পাওয়া যায় স্বর্ণ, আর এমন এক প্রজাতির গাছ রয়েছে সেখানে যে গাছে ঝাকুনি দিলে পাতার বদলে ঝড়ে পড়ে শুধু স্বর্ণ মুদ্রা, কিন্তু মাটি খুড়ে স্বর্ণের দেখা কিংবা গাছে ঝাকুনি দিয়ে স্বর্ণ মুদ্রা আজও কেউ চোখে দেখেনি।

যখন তারা বুঝতে পারে যে মিথ্যে আশ্বাসে তাদের আগমন ঘটেছে এই দেশে। যখন তারা পালানোর চেষ্টা করে তখন তাদেরকে নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করা হতো। দেশীয় মুদ্রার বদলে দেয়া হতো বিশেষ এক ধরনের কয়েন। যে কয়েন কেবল বাগানের ভেতরেই ব্যবহার করা যেতো। একটা সময় তারাও অভ্যস্থ হয়ে যায় এখানে। ফলে তাদের আর ফেরা হয়নি নিজ দেশে।

এখানে এসে কি ভাগ্যের চাকার পরিবর্তন হয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রেমিল শুধু মুচকি হাসি দিলেন। তবে তার ছেলে দয়াল বলেন, ‘দিনভর হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর নাম মাত্র মজুরি। বাইরের দোকানে চা পাতার দাম বাড়লেও বাড়ে না আমাদের দৈনিক মজুরি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গলের একটি চা বাগানের উপ ব্যবস্থাপক আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘চা শ্রমিকদের চিন্তাধারার যতো উন্নতি হবে, চা শিল্পেরও অনেক ব্যাঘাত ঘটবে বলে মনে করেন অনেক বাগান মালিক। সেই কারণে অনেক বাগান মালিক চান না চা শ্রমিকরা অধিকার সম্পর্কে সচেতন হোক।’

তাদের চিন্তাধারা বাগানেই সীমাবদ্ধ কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বাইরের জগতের সঙ্গে তাদের খুব একটা যোগাযোগ নেই। সব কাজকর্ম এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস বাগানের মাঝেই রয়েছে। তাই তাদের চিন্তাধারার উন্নতি হচ্ছে না।’

তবে এই চা বাগান থেকেই বাংলাদেশের একজন নামকরা ডাক্তার হয়েছেন, তার নাম ডাক্তার খয়েড়ি। দৈনিক ডেইলি স্টারের সিলেটের আঞ্চলিক প্রধান মিন্টু দেশুয়ারাও একজন চা বাগানের সন্তান। কয়েকজন অন্তত থাকেন যারা নিজ উদ্যোগে উন্নত করেন তাদের চিন্তাধারার।

বর্তমানে সিলেটের চা বাগানগুলোতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও রয়েছেন বাংলাদেশের কুমিল্লা এবং বরিশাল অঞ্চলের লোকজন। সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানের হিলুয়াছড়া ডিভিশনে বরিশালি পাড়া এবং লাক্কাতুড়া চা বাগানে কুমিল্লা লাইন নামে আলাদা পাড়া রয়েছে। চা বাগানের শ্রমিকদের মতো তারাও একই কাজ করে। পাতা তোলার শ্রমিকদের বেশিরভাগই নারী। হাতেগোনা কয়েকজন পুরুষ মাঝে মধ্যে পাতা তোলার কাজ করে থাকেন। তবে সব বাগানে নয়। এই পুরুষদের বেশিরভাগই আদিবাসি চা শ্রমিকরা।

বাংলাদেশি চা শ্রমিকদের অনেকেই এখন বাগানের বাইরে কাজ করে থাকেন। সিলেটের হিলুয়াছড়া চা বাগানের বাসিন্দা আলখাস আলি (৫২)। বরিশালের ঝালোকাঠিতে ছিল তাদের গ্রামের বাড়ি। নদী ভাঙনের কারণে ঘরবাড়ি, জমিজমা সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে জীবিকার সন্ধানে এই বাগানে আসেন আলখাসের বাবা। আলখাস হিলুয়াছড়া চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপকের বাংলোতে কাজ করলেও তার কোনো ছেলেই বাগানের কাজ করে না।

তবে নূরজাহান আক্তার নামে একজনের সাথে কথা বললে তিনি জানান, ‘বরিশালি লাইনে যারা শ্রমিক আছে, বেশিরভাগ নারীই কাজ করেন বাগানের কর্মকর্তাদের বাসায় এবং চা পাতায় তোলার।’ তবে সাহেবদের বাসায় কাজের চেয়ে চা পাতি তোলার কাজে অনেক সুবিধা বলে জানায় নূরজাহান।

আলখাসের ছেলে আলফাজের (২৯) সাথে কথা বলে জানা যায় সে দুই মেয়ে সন্তানের পিতা। তার সন্তানরা যতটুকু পড়াশোনা করতে পারে এবং যতটুকু পড়াশোনা করানোর মতো সামর্থ আছে সে করাবে। আলফাজ বলেন, ‘পড়াশোনা শেষ করে কপালে যে জায়গায় যাওয়া লেখা আছে সে জায়গায় যাবে।’ বাগানের কোনো কাজে মেয়েদের নিয়োগ দেওয়ানোর ইচ্ছে আছে কি না জানতে চাইলে সে মুচকি হাসি দিয়ে বলেন ‘না’।

আরসি-০৩