জামালগঞ্জ এলজিইডি কার্যালয় ঘুষ-অনিয়ম-দুর্নীতির হাট

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ প্রতিনিধি


আগস্ট ১২, ২০২৫
০৪:৪১ পূর্বাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ১২, ২০২৫
০৪:৪১ পূর্বাহ্ন



জামালগঞ্জ এলজিইডি কার্যালয় ঘুষ-অনিয়ম-দুর্নীতির হাট
#প্রকৌশলীর অঘোষিত ঠিকাদার অফিস সহকারী #এলসিএস কর্মী নিয়োগে উৎকোচ আদায়


সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ঘুষ-অনিয়ম-দুর্নীতির হাটে পরিণত হয়েছে। এলসিএস (লোকাল কমিউনিটি সার্ভিস) নারীকর্মী নিয়োগ থেকে শুরু করে এডিপি, রাজস্ব খাতসহ বিভিন্ন বরাদ্দ থেকে অনৈতিক ফায়দা হাসিলের গুরুতর অভিযোগ আছে খোদ এলজিইডি প্রকৌশলী মো. ছানোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি তথ্য চাওয়ায় ‘এলজিইডি নিয়ে নিউজ কেন?’ জবাব চেয়ে তিনি ক্ষোভ ঝাড়েন এ প্রতিবেদকের উপর। সর্বক্ষেত্রে প্রকৌশলীর এমন লম্ফঝম্ফ থাকলেও উপজেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নীরবতায় জনমনে অসন্তুষ্টি দেখা দিয়েছে।

অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলাকাবাসীর অগোচরে লুটপাট হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ও রাজস্ব খাতসহ অন্য বরাদ্দের টাকা। প্রকৌশলী ছানোয়ার ও অফিস সহকারী মো. মোফাজ্জল হোসেন মিলনের ভাগবাটোয়ায় এসব হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কেউ এ নিয়ে কথা বলতে চাইলে তাকে অন্যত্র বদলি করতেও উঠেপড়ে লাগেন প্রকৌশলী ছানোয়ার। কিন্তু তেরো বছর ধরে একই জায়গায় থেকে নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলেও প্রকৌশলীর ছত্রচ্ছায়ায় বহাল তবিয়তে আছে অফিস সহকারী মিলন। প্রকৌশলীর অঘোষিত ঠিকাদার হিসেবে সবখানে আধিপত্য রয়েছে তার। এ নিয়ে সাধারণ মানুষ, ঠিকাদার, খোদ এলজিইডির ভেতরেই কানাঘুষা আছে।

জানা যায়, চাহিদামতো টাকা না দেওয়ায় কর্মরত এলসিএস নারী কর্মীদের চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। প্রতিজনের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে নিয়ে নতুন ত্রিশজনকে নিয়োগ দিয়েছেন প্রকৌশলী। এতে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। অভিযোগ আছে, একেকজনের ১৫ হাজার টাকার মধ্যে প্রকৌশলী দশ ও সিও পাঁচ হাজার টাকা নেওয়ার ভাগবাটোয়ারা হয়েছে।

কমিউনিটি অর্গানাইজার (সিও) ঝনিক চন্দ্র সরকার, সুপারভাইজার ফয়সল আহমদ ও এলসিএস কর্মী শহরবানুর মাধ্যমে এ টাকা লেনদেন হয়েছে। তবে ঘুষ প্রদানকারী কর্মীদের ভয়ভীতি ও হুমকি-ধমকি প্রদর্শনের কারণে কেউ মুখ খুলতে রাজি হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুরাতন একাধিক এলসিএস কর্মী জানিয়েছেন, সিও ঝনিক জনপ্রতি পনেরো হাজার টাকা চেয়েছে তাদের কাছে। টাকা না দিলে চাকরি থাকবে না। নতুন নাম নেওয়া হবে। তিন বছর মেয়াদী চাকরি টাকা না দেওয়ায় দুই বছরেই শেষ হওয়ার উপক্রম হয়েছে তাদের।

এলজিইডি ও অন্য সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রথম পর্যায়ে ১৫ প্যাকেজে এডিপির ১ কোটি ৮৬ লাখ, রাজস্ব উন্নয়ন খাতে প্রথম পর্যায়ে ১ কোটি ১১ লাখ ৭৫ হাজার, শেষপর্যায়ে ৫৮ লাখ ২৫ হাজার ছাড়াও সব খাত মিলিয়ে প্রায় চার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে।

এসব প্রকল্পের কিছু কিছু কাজ সন্তোষজনক। তবে অধিকাংশই লেপ দিয়ে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা হয়েছে। সংবাদ প্রকাশের প্রস্তুতির খবরে কোন-কোনটির কাজে বেশ তোড়জোড় শুরু হয়েছে। আবার কোনটিতে বালু-পাথর আনার খবরও পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, এডিপির একাধিক প্যাকেজ, রাজস্ব উন্নয়ন খাতের বেশ কয়েকটি প্রকল্প প্রকৌশলী ও অফিস সহকারী মিলে বাস্তবায়ন করেছেন। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে এ সংক্রান্ত কিছু বিষয় জানাজানি হলে টাকা দিয়ে সব ধামাচাপা দেওয়ারও অভিযোগ আছে।

সরজমিনে একাধিক প্রকল্প ঘুরে দেখা যায়, তেলিয়া-শাহপুর অংশে পাঁচ লাখ টাকার কাজে খানাখন্দ ও দুর্ভোগ জিইয়ে রেখে দুই-তিন জায়গায় নামমাত্র ইটসলিং করা হয়েছে। সদর ইউনিয়নের নয়াহালট গ্রামের আবু হানিফার বাড়ি থেকে লতিফ মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত ভাঙাচুরা রাস্তার সংস্কার হয়নি। সরজমিনে গেলে ওই গ্রামের পাবেল মিয়া ও মুছা মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই রাস্তার বরাদ্দ হয়েছে, কিন্তু কাজ হয়নি। সময়সীমা শেষ, কাজও শেষ। মানুষকে ভোগান্তিতে রেখে তারা সরকারি বরাদ্দ খেয়ে ফেলেছে।’

এদিকে, সেলিমগঞ্জ বাজারসংলগ্ন রাস্তা দিনপনেরো আগে সংস্কারবিহীন ছিল। গত কয়দিনের তড়িগড়ি কাজে কোনরকম দায় সেরেছে সংশ্লিষ্টরা। তবে দশ লাখ টাকার এ কাজে বাহাদুরপুরের ভাঙ্গা যে রকম ছিল সে রকমই আছে। এ ভাঙ্গায় মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে দেখা গেছে।

খবর নিয়ে জানা যায়, বেহেলী ইউনিয়নের আছানপুর গ্রামের সদ্য ঢালাই করা রাস্তাটি কোনরকম লেপ দেওয়া হয়েছে। চলতি বর্ষা মৌসুম পার হবে কি না, শঙ্কা প্রকাশ করে স্থানীয় একজন বলেন, ‘মাসখানেক হয় কাজটা হয়েছে। মাল-মসলা কম দিয়ে কোনরকম দায় সেরেছে কন্ট্রাক্টর (ঠিকাদার)। কিছুদিন যাওয়ার পর বোঝা যাবে কতটুকু কাজ হয়েছে।’

অপরদিকে, নবীন চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী রাস্তার সিসিকরণ কাজেও পুকুরচুরির ঘটনা ঘটেছে। অনেকটা অগোচরে কাজ হয়েছে জানিয়ে বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, স্কুলে আসার পথে হঠাৎ দেখি ঢালাইয়ের কাজ চলছে। এলজিইডির মিলন ভাইকে দেখলাম খুব দৌড়ঝাঁপ করতে। যেমন খুশি তেমন কাজই হয়েছে এখানে। এর বেশি বলতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন তিনি।

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কেবিএফ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. নূরুজ্জামান বলেন, ‘আমার নামে দুই প্যাকেজের (২৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা) কাজ এলজিইডির মিলন ভাই দুইজন মেম্বারকে দিয়ে করিয়েছেন। টেন্ডার পেলেও কাজ আমি করিনি। কাজের ব্যাপারে কিছু জানি না।’

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রথম সারির এক ঠিকাদার বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী সব কাজ টেন্ডারে হওয়ার কথা। কিন্তু মনগড়া লোক দিয়ে অনেক কাজ তারা নিজেরাই করে ফেলে। আমরা তাদের অধীনস্থ থাকায় কিছু বলতে পারি না। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেও লাভ হয় না।’

বিল আদায়ে ঘুষ দিয়েছেন এমন এক ঠিকাদার জানান, প্রকৌশলী ছানোয়ার দুই ধাপে একান্ন হাজার টাকা নিয়েছেন। অসংলগ্ন কথাবার্তা বলায় তার সঙ্গে হাতাহাতির উপক্রম হয়েছিল বলে জানিয়েছেন তিনি।

অনেক কাজে মিলন জড়িত স্বীকার করে উপজেলা প্রকৌশলী মো. ছানোয়ার হোসেন গণমাধ্যমে বলেন, ‘কাজের অনিয়ম সম্পর্কে আমি জড়িত না। এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। এলসিএস নারীকর্মী নিয়োগ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী হয়েছে। দপ্তরের সংশ্লিষ্ট লোক এর যাচাই-বাছাই করেছে। যারা বঞ্চিত হয়েছে তারাই অভিযোগ করছেন।’

এলসিএস কর্মী নিয়োগের বিষয়টি আমার বিষয় না জানিয়ে জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুশফিকীন নূর বলেন, ‘এডিপি-রাজস্ব উন্নয়ন কাজের সভাপতি আমি। আমার স্বাক্ষরে বাস্তবায়ন হয় এটা ঠিক। তবে পুঙ্খাপুঙ্খভাবে সবকিছু দেখা সম্ভব হয় না। যেসব কাজে ত্রুটি আছে, কিংবা হয়নি সেগুলো তদন্ত করে দেখবো। যদি গাফিলতি হয়ে থাকে তাহলে প্রকৌশল অধিদপ্তরকে বলবো ব্যবস্থা নিতে।’

সুনামগঞ্জ এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এডিপি-রাজস্ব খাতের বরাদ্দ সম্পর্কে প্রকৌশলী ও ইউএনও মহোদয় ভালো বলতে পারবেন। এ কাজে আমাদের সম্পৃক্ততা নেই। এললিএস নারী কর্মী নিয়োগের বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। গরীব নারী কর্মীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগ কেউ দিলে তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।



এএফ/০৪