সিলেট মিরর ডেস্ক
আগস্ট ২৬, ২০২৫
০২:১৪ পূর্বাহ্ন
আপডেট : আগস্ট ২৬, ২০২৫
০২:১৬ পূর্বাহ্ন
ঐতিহ্যবাহী আলী আমজদের ঘড়িঘর প্রাঙ্গণে জুলাই শহীদদের স্মরণে নির্মিতব্য স্মৃতিফলকের কাজ স্থগিত করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা, নির্মিতব্য স্মৃতিফলক অপসারণে ঐতিহ্যপ্রেমীদের স্মারকলিপি প্রদান ও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের কারণে কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
সোমবার (২৬ আগস্ট) সন্ধ্যা সোয়া সাতটার দিকে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাই রাফিন সরকার বলেন, যেহেতু সিলেটের অনেকে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার আদল যথাযথ রেখে পাশেই অন্য কোনো স্থানে স্মৃতিফলক নির্মাণের পরামর্শ দিচ্ছেন, তাই আপাতত নির্মাণকাজ স্থগিত রাখা হয়েছে। স্মৃতিফলক কোথায় নির্মাণ করা যায়, সবার সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে কাজ শেষ করা হবে।
পূর্বের সংবাদ- আলী আমজদের ঘড়িঘরে স্মৃতিস্তম্ভ, নাগরিক সমাজের ক্ষোভ |
আজ সোমবার বেলা একটার দিকে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলমের কাছে সিলেটের ঐতিহ্য ও পরিবেশবাদী তিনটি সংগঠনের প্রতিনিধিরা স্মারকলিপি দেন। এতে তাঁরা জুলাই শহীদদের স্মরণে নির্মিতব্য ‘স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্প’ আলী আমজদের ঘড়ির কাছ থেকে সরিয়ে অন্যত্র প্রতিস্থাপনের দাবি জানান। এ ছাড়া বেলা দুইটায় সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাই রাফিন সরকারের কাছেও একই স্মারকলিপির একটি কপি তাঁরা তুলে দিয়েছেন।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, সিলেটের মুক্তিকামী সংগ্রামের ইতিহাসে জুলাই আন্দোলনের গুরুত্ব অস্বীকারযোগ্য নয়। কিন্তু ঐতিহাসিক আলী আমজদের ঘড়িঘরের গায়ে নতুন স্থাপনা চাপিয়ে দেওয়া সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও স্থাপত্য রক্ষার মৌলিক নীতির পরিপন্থী। নির্মিতব্য স্মৃতিফলকটি দ্রুত অপসারণের জন্য স্মারকলিপিতে বলা হয়।
পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্ট সিলেট, ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সিলেট এবং সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন নামের তিনটি সংগঠন স্মারকলিপি দিয়েছে। এ সময় ধরা সিলেটের আহ্বায়ক মোস্তফা শাহজামান চৌধুরী, সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন সিলেটের সমন্বয়ক আবদুল করিম চৌধুরী কিম, সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের প্রধান পরিচালক শামসুল বাসিত শেরো, প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান চৌধুরী, পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্টের প্রতিনিধি রেজাউল কিবরিয়া উপস্থিত ছিলেন।
পূর্বের সংবাদ- আলী আমজদের ঘড়িঘরে নির্মিতব্য স্থাপনা অপসারণের দাবিতে স্মারকলিপি |
স্মারকলিপিতে বলা হয়, সিলেট শহরের প্রাচীনতম ও প্রতীকখ্যাত স্থাপত্য আলী আমজদের ঘড়িঘর কেবল একটি স্থাপনা নয়; এটি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পরিচয়ের প্রতীক। ১৮৭৪ সালে পৃত্থিমপাশার জমিদার নবাব আলী আহমদ খান ঘড়িটি নির্মাণ করেন। নামকরণ করেন নিজের ছেলে আলী আমজদ খানের নামে। শতবর্ষ অতিক্রান্ত এ স্থাপনাটি সিলেটকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিত করেছে। সুরমা নদীর তীরে অবস্থিত এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য কেবল একটি ঘড়িঘর নয়, বরং সিলেটের অস্তিত্ব, ইতিহাস ও নাগরিক ঐতিহ্যের দৃশ্যমান প্রতীক। এতে আরও বলা হয়, ঐতিহ্যবাহী ঘড়িঘরের সীমানার ভেতরেই নতুন একটি স্থাপনার (জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদ স্মরণে জুলাই স্মৃতিফলক) নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। ঐতিহাসিক স্থাপনার পাশে নতুন স্থাপনা নির্মাণে ঐতিহাসিক মর্যাদা, স্থাপত্যের নান্দনিকতা ও স্বকীয়তাকে বিকৃত করবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এটি আমাদের দায়িত্বহীনতা ও ঐতিহ্য অবমাননার নজির হয়ে থাকবে। এ ছাড়া ইতিমধ্যেই সিলেট শহরে রিকাবিবাজার এলাকার কবি নজরুল অডিটরিয়ামের পাশে একটি জুলাই স্তম্ভ নির্মাণাধীন রয়েছে। ফলে একই উদ্দেশ্যে আরেকটি কাঠামো তৈরি করা অপ্রয়োজনীয়।
ঐতিহ্যবাহী আলী আমজদের ঘড়ির ঐতিহ্য, নান্দনিকতা ও আইনগত মর্যাদা রক্ষায় চলমান নতুন স্থাপনার কাজ অবিলম্বে বন্ধ করা এবং ইতিমধ্যে নির্মিত কাঠামো অপসারণের জন্য জরুরি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য স্মারকলিপিতে বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, জুলাই আন্দোলনের স্মৃতি সংরক্ষণের বিকল্প স্থান সিলেট শহরে বহু রয়েছে। সেখানে ফলক, স্মারক কিংবা স্তম্ভ নির্মাণ করা যেতে পারে। কিন্তু তা কখনোই সিলেটের প্রতীকখ্যাত ঐতিহ্যের ক্ষতির বিনিময়ে নয়।
স্মারকলিপিতে স্থাপনাটি সংরক্ষণে আইনগত ভিত্তি হিসেবে তিনটি বিষয় উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে: বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব আইন, ১৯৬৮ (সংশোধিত ১৯৭৬ ও ২০১৬) অনুযায়ী প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক স্থাপনার সীমানায় কোনো নতুন স্থাপনা নির্মাণ বা পরিবর্তন আনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। দ্বিতীয়টি হচ্ছে: জাতীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ নীতি, ২০০৯ অনুযায়ী ঐতিহাসিক স্থাপনা ও প্রতীকের চারপাশের দৃশ্যময়তা, পরিবেশ ও নান্দনিকতা অক্ষুণ্ন রাখা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। তৃতীয়টি হলো: ইউনেসকো হেরিটেজ সংরক্ষণ নীতি অনুযায়ী আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নির্দেশনা অনুযায়ী, শতবর্ষ প্রাচীন স্থাপনার ভৌগোলিক ও স্থাপত্যগত অখণ্ডতা, তা নষ্ট করা যায় না।
সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের স্মরণে প্রত্যেকের জন্য আলাদাভাবে ঘটনাস্থলে কিংবা ঘটনাস্থলের ঠিক পাশে একই নকশায় ‘স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্প’ নামে স্মৃতিফলক নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। সিলেট নগরে চারজন শহীদ স্মরণে এমন স্মৃতিফলক নির্মাণের কাজ গত জুলাই মাসে শুরু হয় এবং আগস্ট মাসে শেষ হওয়ার কথা। নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করছে সিলেট সিটি করপোরেশন।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, স্মৃতিফলক নির্মাণের স্থান চূড়ান্ত করতে একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। বিশেষত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শহীদদের শহীদ হওয়ার স্থান দেখিয়ে দিয়েছেন। সে অনুযায়ী ঘটনাস্থল এবং ঘটনাস্থলের কাছাকাছি স্মৃতিফলক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আলী আমজদের ঘড়ির সামনে মো. পাবেল আহমদ কামরুল ও পঙ্কজ কুমার কর শহীদ হন। তাই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেখানে দুই শহীদ স্মরণে স্মৃতিফলক নির্মিত হচ্ছে।
এর বাইরে কোর্ট পয়েন্ট মধুবন মার্কেটের সামনে শহীদ সাংবাদিক আবু তাহের মো. তুরাব এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষার্থী রুদ্র সেন স্মরণে ঘটনাস্থলের পাশে স্মৃতিফলক নির্মিত হচ্ছে। প্রতিটি ফলক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ৩৭৫ টাকা। এরই স্মৃতিফলক নির্মাণে বেশির ভাগ অংশের কাজ শেষ হয়েছে।
ঘড়িঘরের বেষ্টনীর মধ্যে দুজন শহীদ স্মরণে স্মৃতিফলক নির্মাণের বিষয়ে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সিলেটের সদ্যবিদায়ী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের সভাপতিত্বে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা, মহানগর পুলিশ, গণপূর্তসহ কয়েকজনের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি স্মৃতিফলক নির্মাণের স্থান চূড়ান্ত করেছে। সে অনুযায়ী সিটি কর্তৃপক্ষ দুই শহীদ স্মরণে আলী আমজদের ঘড়ির পাশে দুটি স্মৃতিফলক নির্মাণে কাজ শুরু করে।
এএফ/০২