সিলেট মিরর ডেস্ক
এপ্রিল ০৪, ২০২০
১০:৫৬ পূর্বাহ্ন
আপডেট : এপ্রিল ০৪, ২০২০
০২:৫২ অপরাহ্ন
করোনা মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে বিএনপি। একাসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষকে সহায়তায় ৮৭ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠনে সরকারের কাছে প্রস্তাব করেছে বিএনপি। পরিস্থিতি মোকবিলায় যে কোনো গঠনমূলক ও কল্যানমুখী উদ্যোগে বিএনপি শামিল হতে প্রস্তুত রয়েছে বলেও জানানো হয়েছে।
গতকাল শনিবার (০৪ এপ্রিল) করোনা সংকট মোকাবিলায় অর্থনৈতিক প্যাকেজ প্রস্তাবনা ঘোষণার জন্য দলের পক্ষ থেকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, ‘জাতীয় ও বৈশ্বিক মহাদুর্যোগ মোকাবেলায় যে কোনো গঠনমূলক ও কল্যাণমুখী উদ্যোগে শামিল হতে বিএনপি প্রস্তুত রয়েছে। এ দুর্যোগ পরিস্থিতিতে দম্ভ, অহংকার ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পরিহার করে সরকারকেই এই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা এই মহাদুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব করোনাভাইরাস জনিত বৈশ্বিক মহামারির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সম্ভাব্য মহাদুর্যোগ মোকাবিলায় বিএনপির পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট ২৫টি প্রস্তাব তুলে ধরেন।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, তাদের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য জিডিপির ৩ শতাংশ অর্থের সমন্বয়ে ৮৭ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল ঘোষণা করতে হবে। এর মধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে স্বল্প-মেয়াদি, অনতিবিলম্বে। কিছু মধ্যমেয়াদি এবং কিছু দীর্ঘমেয়াদি। স্বল্প-মেয়াদি খাতে ৬১ হাজার কোটি টাকা, আর মধ্য-মেয়াদি খাতে ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে ৮ হাজার কোটি টাকা অদৃশ্য খাত এবং অন্যান্য খাতে ব্যয় করা যাবে। যাতে শাটডাউন প্রত্যাহার হলে সব খাতের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সাধারণ ছুটি-পূর্ব স্তরে ফিরে আসতে সক্ষম হয়।
মির্জা ফখরুল ইসলাম জানান, অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বিএনপির এই প্রস্তাবনা জরুরিভাবে বাস্তবায়নের জন্য তারা সরকারের কাছে পাঠাবেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে দ্রুত সাহায্য পৌঁছাতে হবে। এর মধ্যে থাকবে দৈনিক মজুরিভিত্তিক গ্রুপ, অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টর, আত্মকর্মসংস্থানকারী, গ্রামীণ ভূমিহীন কৃষক, কৃষি শ্রমিক, মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স, গণপরিবহন শ্রমিক, রোড সাইড ভেন্ডর, সকাল-বিকাল বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে উপার্জনকারী গ্রুপ ইত্যাদি।’
‘দিন এনে দিন খায়’ শ্রমিকদের কথা উলেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, ভ্যানচালক, হকার, ভাসমান শ্রমিক, ছিন্নমূল, ভিক্ষুক, ভবঘুরে, সিএনজি ড্রাইভার, ভাড়াভিত্তিক গাড়িচালক, পরিবহন শ্রমিক, বস্তিবাসী এরা মহামারীর কারণে ঘোষিত লকডাউনে কর্মহীন হয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপের অংশ হিসেবে অনতিবিলম্বে এদের মুখে খাবার তুলে দেওয়া অপরিহার্য। প্রাথমিকভাবে এপ্রিল-মে-জুন এই তিন মাসের জন্য জনপ্রতি ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করে অনতিবিলম্বে ঘরে ঘরে গিয়ে অর্থ নগদ পরিশোধ করতে হবে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘প্রয়োজনে সামরিক বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত¡াবধানে প্রাথমিকভাবে তিন মাসের জন্য আশ্রয়হীনদের অস্থায়ী আবাসন ও তাদের দুই বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য ন্যূনতম আট হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে।’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ৮০ লাখের বেশি শ্রমিক বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে কাজ করছে। তাদের নগদ সাহায্য দিতে হবে। ছয় মাসের জন্য দুই কিস্তিতে প্রথম তিন মাসের এবং পরবর্তী কিস্তিতে অবশিষ্ট টাকা নগদ দেওয়া যেতে পারে। এ খাতে প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে হবে। ব্যাংকিং চ্যানেলে শ্রমিকদের স্ব স্ব অ্যাকাউন্টে কিস্তির নগদ টাকা পরিশোধ করতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র এবং নিয়োগপত্র দেখে এদের চিহ্নিত করতে হবে।
স¤প্রতি দেশে ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের কথা উলেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, অনেকেই শূন্য হাতে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। এদের চিহ্নিত করে প্রত্যেক প্রবাসীকে তিন মাসের জন্য মাসিক ১৫ হাজার টাকা আপদকালীন আর্থিক সাপোর্ট দিতে হবে। এ জন্য এ খাতে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে। একইসঙ্গে বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশি প্রবাসীদের চাকরি সুনিশ্চিত ও তাদের যেন ছাঁটাই না করে তা নিশ্চিত করতে সরকারকে আহŸান জানান।
স্বাস্থ্য খাত এবং যারা করোনা মোকাবিলার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত সেসব হাসপাতাল এবং সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রাথমিকভাবে ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন মির্জা ফখরুল। স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করে আগামী তিন মাসের জন্য প্রতি চিকিৎসকের জন্য এক কোটি, নার্সদের জন্য ৭৫ লাখ এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ৫০ লাখ টাকার বিমার বিপরীতে প্রিমিয়াম সরকার বহন করবে।
জরুরিভিত্তিতে দ্রুতগতিতে পিপিই, করোনা পরীক্ষার কিট ও আনুষঙ্গিক ওষুধ ও দ্রব্যাদি সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়ার আহŸান জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, রাজধানী, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে করোনা রোগীদের জন্য পৃথক হাসপাতাল স্থাপন, চিহ্নিতকরণ, পৃথক কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক/নার্সদের করোনা পরীক্ষা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও জরুরি ভিত্তিতে পর্যাপ্ত জনবল নিশ্চিত করতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে নতুন আইসিইউ স্থাপনের জন্য ভেন্টিলেটরসহ উন্নত চিকিৎসা সামগ্রী শুল্কমুক্ত আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে কমিউনিটি সেন্টার, কনভেনশন হল ও রাজধানীর বড় বড় শূন্য আবাসিক হোটেলগুলোকে সাময়িকভাবে হাসপাতালে রূপান্তরিত করে জরুরি স্বাস্থ্য সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে করোনায় আক্রান্তদের নদীতে ভাসমান জাহাজে আইসোলেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা দেওয়া যেতে পারে। তাতে আক্রান্তের হার কমে আসবে।
বয়স্ক নারী, বিধবা, প্রতিবন্ধী, ষাটোর্ধ্ব বয়স্কদের প্রতি মাসে জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা করে আগামী তিন মাস নগদ অর্থ বিতরণ করার প্রস্তাবনা দিয়ে মির্জা ফখরুল আরও বলেন, এ খাতে আপাতত দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে। এ ছাড়া দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা পরিবারকে আগামী তিন মাসের জন্য বিনা মূল্যে রান্নার গ্যাস, গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার সরবরাহ করতে হবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত কোনও ঋণ গ্রহীতাকে ঋণ খেলাপি ধরা হবে না। বিএনপি সুপারিশ করেছে, এই সময়কালীন ঋণের সুদ মওকুফ করতে হবে। ইএমআই (ঋণের নিয়মিত কিস্তি) পরিশোধ তিন মাসের জন্য স্থগিত করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এখনই ব্যাংক খাতে তারল্য বৃদ্ধি করার পদক্ষেপ নিয়ে ফিন্যান্সিয়াল মার্কেটে আস্থা বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দিয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, স¤প্রসারণশীল মনিটরিং পলিসি নিতে হবে। বেসরকারিভাবে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে, এটা ন্যূনতম ১৫ থেকে ১৬ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।
মির্জা ফখরুল আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্পের জন্য এবং বিশেষ করে দেশের জন্য ব্যবহৃত পণ্য প্রস্তুতকরী প্রতিষ্ঠানের জন্য পুনঃঅর্থায়ন করতে হবে। ন্যূনতম ১০ হাজার কোটি টাকার ফান্ড তৈরি করে সর্বোচ্চ তিন শতাংশ হারে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে হবে। ব্যবসায় অচলাবস্থার কারণে যেসব এসএমই অর্থ প্রবাহ সমস্যায় পড়েছে, তাদের সুনির্দিষ্ট রিলিফ-প্যাকেজ দিতে হবে।
সরকারের ব্যয় সংযত করার দাবি জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, অপচয় বন্ধ করে সেই অর্থ দিয়ে রফতানিমুখী শিল্প, ওষুধ শিল্প এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় শিল্পকে আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে। বিশেষ করে করনীতির আওতায় করপোরেট করের হার কমানো, আপদকালীন সময়ের জন্য কর মওকুফ করা এবং ব্যক্তিগত এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স আদায় করা বন্ধ করতে হবে। মেগা প্রকল্পগুলোর অর্থ ব্যয় কিছুটা মন্থর করা যেতে পারে।
আগামী মৌসুমে স্থানীয় বাজারে কৃষক পর্যায়ে পর্যাপ্ত খাদ্য কিনে মজুদ করার প্রস্তাবনা দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, এ খাতে প্রাথমিকভাবে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ী, মজুতদার ও দালাল শ্রেণির লোকদের নজরদারিতে রেখে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা এবং উৎপাদন ও সরবরাহ-চেইন নির্বিঘ্ন রাখতে হবে। অবিলম্বে সরকারকে বিশ্ব ব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও আইএমএফসহ দ্বি-পাক্ষিক আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে।
গণমাধ্যমের জন্য আর্থিক প্যাকেজ প্রদানের সুপারিশ করে মির্জা ফখরুল বলেন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন,স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার, তথ্য প্রবাহ ও জনমতামত তুলে ধরে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মীরা অনেক সময় ঝুঁকি নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়িত্ব পালন করে আসছেন। করোনাভাইরাস মহামারীতে সংবাদকর্মীরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে যে আর্থিক প্যাকেজ পেশ করা হয়েছে তার অধিকাংশই যুক্তিসঙ্গত। দেশের এই ক্রান্তিকালে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সাংবাদিকদের আর্থিক ও অন্যান্য দাবিগুলো সুবিবেচনা করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাব
বিএনপির এই নেতা বলেন, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংককে তাদের মৌলিক ভূমিকায় ফিরে এসে বিধ্বস্ত ও বিশৃঙ্খল অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যথাযথ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্য আর্থিক, ব্যাংকিং ও কর ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত নীতি গ্রহণ করতে হবে।
ভবিষ্যতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে যারা বাস্তব কারণে দেশে ফিরতে বাধ্য হবে তাদের সহজ শর্তে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি।
দেশে ভবিষ্যতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ভেন্টিলেটর নির্মাণ শিল্প গড়ে তুলতে হবে বলে উলেখ করেন তিনি।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, গণমাধ্যমের সাংবাদিক, সামরিক বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিজ্ঞানী, রোগতত্ত¡ বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের নিরলস ভূমিকার প্রশংসা করে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন বিএনপি মহাসচিব।