হতদরিদ্রদের তালিকায় মৃৃত, স্বচ্ছল, প্রবাসীদের নাম

দোয়ারাবাজার (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি


এপ্রিল ২২, ২০২০
০৩:০৭ অপরাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ২২, ২০২০
০৪:০২ অপরাহ্ন



হতদরিদ্রদের তালিকায় মৃৃত, স্বচ্ছল, প্রবাসীদের নাম
দোয়ারাবাজারে ক্ষোভ ও সমালোচনার ঝড়

তালিকায় নাম থাকার কথা এলাকার হতদরিদ্রদের। অথচ সেখানে হতদরিদ্রদের পাশাপাশি নাম উঠেছে এলাকার স্বচ্ছল, স্বাবলম্বী, এমন কী প্রবাসীদের নামও। এমনকি কয়েক বছর আগে যারা মারা গেছেন তাদের নামও স্থান পেয়েছে। তালিকার বাইরে রয়ে গেছেন জীবনযুদ্ধে পরাজিত অনেক হতদরিদ্রের নাম। করোনাভাইরাস মহামারির এই সময়ে হতদরিদ্রদের এমন তালিকা দেখে হতবাক সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলাবাসী। অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, চলছে সমালোচনা।অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ জানিয়ে দাবি তুলেছেন, ‘তালিকায় যেসব স্বচ্ছলদের নাম এসেছে তাদের বাড়ির সামনে ‘হতদরিদ্রের বাড়ি’ লিখে সাইনবোর্ড টানানো হোক।

জানা গেছে, সম্প্রতি সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক সরকারি ওয়েবসাইটে ২০২০ সালের চলতি বছরের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতাধীন দোয়ারাবাজার উপজেলার ইউনিয়ন পর্যায়ে হতদরিদ্রদের তালিকা প্রকাশ করেছে। ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এই তালিকায় উপজেলার সবকটি ইউনিয়নের হতদরিদ্রের নাম প্রকাশ হওয়ার কথা। কিন্তু প্রকাশিত খাদ্যবান্ধব তালিকায় হতদরিদ্রদের নামের বদলে স্থান পেয়েছে অনেক স্বচ্ছল পরিবারের সদস্যদের নাম। সে তালিকায় দেখা যাচ্ছে একই পরিবারের একাধিক মৃত সদস্যসহ দেশের বাইরে থাকা প্রবাসীদের নামও। একাধিক সুবিধাভোগীদের নামও স্থান পেয়েছে তালিকায়। প্রকৃত হতদরিদ্রদের নাম বাদ পরলেও বাদ যায়নি স্বচ্ছল সরকারি চাকুরিজীবী পরিবারের সদস্যদের নাম। এই তালিকা দেখে হতাশ হয়েছেন সুবিধাবঞ্চিত হতদরিদ্র পরিবারের লোকজনসহ উপজেলার সচেতন মহল। প্রতিক্রিয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে চলছে সমালোচনার ঝড়। 

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের (আলীপুর, হাছানবাহার, বৈঠাখাই) তালিকায় ৪৬৮ নং ক্রমিকে স্থান পেয়েছে প্রবাসী নুরুল ইসলামের নাম। তিনি দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে। তার এক সন্তান সরকারি চাকুরিজীবী। ৪৭০ নং ক্রমিকে নাম থাকা গৃহিণী রাজিয়া খাতুনের দুই সন্তান সরকারি চাকুরিজীবী এবং তার পরিবার আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল।

তালিকায় নিজের মায়ের নাম থাকা প্রসঙ্গে রাজিয়া খাতুনের ছেলে সরকারি চাকুরিজীবী লোকমান হোসেন বলেন, ‘তালিকায় কিভাবে আমার মায়ের নাম এসেছে তা আমরা জানিনা। নাম দেখে আমি নিজেও অবাক হয়েছি।’

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে ৭ নং ওয়ার্ডের তালিকায় নাম থাকা অন্যান্যদের তিন-চতুর্থাংশই আর্থিকভাবে স্বচ্ছল এবং কর্মক্ষম। একই ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের (খাগুরা, বরকতনগর, জিয়াপুর, গোজাউরা) তালিকায় ৬৪২ নং ক্রমিকে এসেছে ভাতাপ্রাপ্ত মৃত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিমের নাম। তালিকার ৬৫২ নং ক্রমিকে তার মৃত স্ত্রী আমেনা বেগমের নামও এসেছে। শুধু মৃত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম ও তাঁর মৃত স্ত্রী আমেনা বেগমের নামই হতদরিদ্রের তালিকায় অন্তভুর্ক্ত হয়েই শেষ হয়নি। আমেনা বেগমের পরের সিরিয়ালে ৬৫৩ নং ক্রমিকে এসেছে তাদের সন্তান মো. ফরিদ মিয়ার নাম। তিনিও আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। জীবিত-মৃত একই পরিবারের তিনজনের নাম হতদরিদ্রের তালিকায় স্থান পেলেও তাতে স্থান পায়নি ওই ওয়ার্ডের অনেক প্রকৃত হতদরিদ্রদের কারোরই নাম। তালিকায় একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তির নামও দেখা গেছে। শুধু ৭ ও ৯ নং ওয়ার্ডেই নয়, সুরমা ইউনিয়নের অন্যান্য ওয়ার্ডসহ উপজেলার সব প্রায় সবকটি ইউনিয়নের হতদরিদ্রদের নামের তালিকায় দায়সারা গোঁজামিল পাওয়া গেছে।

উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের বরকত নগরের বাসিন্দা দোয়ারাবাজার উপজেলা প্রবাসী সমাজ কল্যাণ সংস্থার উপদেষ্টা মো. গোলাম রহমান গোলাপ বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডের হতদরিদ্রদের নামের তালিকায় মৃত ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তিসহ একজন ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের তিনজন কিভাবে স্থান পায়? এটা একটা দায়সারা তালিকা। এখানে হতদরিদ্রদের বদলে স্বচ্ছল পরিবারের সদস্যরাই বেশি স্থান পেয়েছে। আমি প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করেও কোনো সদুত্তর পাইনি।’

একইভাবে হতদরিদ্রদের তালিকায় স্বচ্ছল, মৃৃত ব্যক্তির নাম এসেছে উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নেও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শিক্ষক আবদুল করিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'আমাদের পাশের বাড়ির যে লোক বছরেরও বে< আগে মারা গিয়েছে, তার নাম ২৪২ নম্বর সিরিয়ালে আছে।'

এমন ঘটনায় ঝড় উঠেছে সামাজিকে যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও। ক্ষোভ প্রকাশ করে মাহমুদুর রহমান নামে একজন সেখানে ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘যে সকল হারামখোর সচ্ছল পরিবার হতদরিদ্রের মাল খাচ্ছে তাদের বাড়িতে “হতদরিদ্রের বাড়ি” লিখে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেয়া উচিৎ।’ জামাল উদ্দিন নামে আরেকজন মন্তব্য করেছেন ‘এটা দেখে মনে হচ্ছে ভোটার তালিকা। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায় ভোটার তালিকা জমা দেওয়া হয়েছে।’ একই রকম মন্তব্য করেছেন নজরুল ইসলাম ও এম কে মামুন নামে দুজন ফেসবুক ব্যবহারকারী।

এ ব্যাপারে সুরমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মামুনূর রশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘পরিষদের প্রত্যেক মেম্বারদেরকে বলা হয়েছে স্থানীয়দের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রকৃত হতদরিদ্রদের তালিকা দেওয়ার জন্য। আমার ইউনিয়নের কেউ বাদ পড়লে কিংবা স্বচ্ছলদের নাম তালিকায় আসলে আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখব। তবে উপজেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে সম্প্রতি ২০২০ সালের যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে এটি আগের তালিকা। নতুন তালিকা হয়তো আপডেট দেওয়া হয়নি।’

এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোনিয়া সুলতানা বলেন, ‘ উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়নের হতদরিদ্রদের তালিকায় সমস্যা নেই, শুধুমাত্র সুরমা ইউনিয়নের তালিকায় একটু সমস্যা আছে। গতকালকে সুরমা ইউপি চেয়ারম্যানের সাথে মোবাইলে আলাপ হয়েছে। তালিকাটা সংশোধন করে দুয়েকদিনের মধ্যেই ওয়েবসাইটে আপডেট দেওয়া হবে।’ 

 

এমএইচএইচ-০১/এএফ-০৩