মানবতার ফেরিওয়ালা

নিজস্ব প্রতিবেদক


মে ০১, ২০২০
০৩:৪১ পূর্বাহ্ন


আপডেট : মে ০১, ২০২০
০৬:৫৬ পূর্বাহ্ন



মানবতার ফেরিওয়ালা
করোনা যুদ্ধে ছুটে চলা একজন সফি

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মোকাবেলায় গোটা বিশ্ব এখন দিশেহারা। সংক্রমণরোধে সর্বত্র চলছে লকডাউন। দোকানপাট বন্ধ। কর্মহীন হয়ে পড়ায় নানাবিধ সংকট বাড়ছে।নিম্নবিত্ত তো বটেই মধ্যবিত্তরাও সংকটে পড়েছেন। কারো কাছে হাত পাততেও পারছেন না অনেকে। এই পরিস্থিতিতে মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে দিনরাত সিলেটের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটে চলেছেন একজন সফি আহমদ। সাধ্যমতো সহায়তা তুলে দিচ্ছেন দুর্দশাগ্রস্থ পরিবারের হাতে। অনেকটা নীরবে-নিভৃতে তিনি এই তৎপরতা চালালেও ইতোমধ্যে তিনি ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। 

মো. সফি আহমেদ একজন পুলিশ সদস্য। সিলেট মহানগর পুলিশের নায়েক পদে কর্মরত। বর্তমানে তিনি মহানগর পুলিশের মিডিয়া ও কমিউনিটি সার্ভিস বিভাগে কর্মরত আছেন। তার বাবা ছিলেন দেশের সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং সাধারণ ছুটি ঘোষণার পরদিন থেকেই মূলত তিনি কাজ শুরু করেন। প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন শেষে নিজের মোটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের খোঁজে। গরীব ও অসহায় মানুষের ঘরে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন মো. সফি আহমেদ। সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকে প্রতিদিন মোটরসাইকেলে করে ঘুরে ঘুরে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছেন তিনি।

সফি আহমদের পথচলা শুরু গল্পটাও অন্যরকম। প্রথমে নিজের দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগিতা করার আগ্রহ থেকেই তিনি পথে নামেন। কিন্তু যখন দেখেন সংকট সর্বত্র তখন তিনি আর নিজের মধ্যে তৎপরতা সীমাবদ্ধ রাখতে পারেননি। যেখানেই দুর্দশাগ্রস্থ মানুষ দেখেছেন সেখানেই বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত। তাঁর এই তৎপরতা সহজেই সকলের নজর কাড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রশংসায় ভাসতে থাকেন সফি আহমদ। অনেকেই তাঁকে ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। 

সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অফিসের ডিউটি করেন। তারপর মোটরসাইকেল বেরিয়ে পড়েন খাদ্যসামগ্রী বিতরণে।

 

এই উদ্যোগ শুরু সম্পর্কে সফি আহমেদ বলেন, “প্রথমদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ হতে চাই-শিরোনামে নিজের মোবাইল নাম্বার দিয়ে একটা পোস্ট করি। তখন অবশ্য টাকার বিনিময়ে খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। যাতে মানুষজন বাসায় থাকেন। তবে যতগুলো ফোন আসে সবাই ফোন দিয়ে জানায় তাদের কাছে খাবারের কিছু নেই হাতে টাকাও নেই। তখন থেকে বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করে আসছি।”

তিনি জানান, গত ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে এসবিসি নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে ৫০টা পরিবারের হাতে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেন তিনি। এরপর থেকে আজ অবধি ব্যাক্তিগত উদ্যোগে প্রতিদিন সিলেটের বিভিন্ন পরিবারের হাতে খাদ্যসামগ্রী তুলে দিচ্ছেন। নিজের অফিসের দায়িত্ব পালন শেষ করে মোটরসাইকেলে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ছুটে চলেন গরীব অসহায়দের ঘরে। তবে তার এই উদ্যোগে শুধু গরীব অসহায়রা সাহায্য পাচ্ছেন তা নয়। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার তাঁর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে সাহায্য নিচ্ছেন।

সফি আহমদ জানান, তাঁর বাবা ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমানে তিনি বেঁচে নেই। বাবার মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকা, পেনশনের টাকা, পরিবারের সদস্য, পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা ,সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে পাওয়া সাহায্য থেকেই তিনি এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।এই কার্যক্রম চালাতে গিয়ে তাকে কিছুটা ঋণগ্রস্থও হতে হয়েছে। এছাড়া সিলেট মহানগর পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাসহ সবাই আর্থিক সহযোগিতাসহ সবধরণের সহযোগিতা করছেন বলেও তিনি জানান।

সফি আহমদ জানান, প্রতিদিন প্রায় ১০- ১৫টা পরিবারের কাছে এসব খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেন তিনি। এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ ২৮টি পরিবারের কাছে এসব বিতরণ করেছেন। খাদ্যসামগ্রী মধ্যে আছে চাল, ডাল ,তেল, আলু, পেঁয়াজ, সাবান ও বাচ্চাদের জন্য একটি চিপস। তবে কারোর চাহিদা অনুযায়ী কোনো কোনো প্যাকেটে দুধ ও মশলাও দেওয়া হয়। 

তিনি জানান, শুধু সিলেটে না, নিজের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলায়ও দুই বন্ধুর সাহায্যে ১০০ পরিবারকে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। রমজান মাসে সিলেটে খাদ্যসামগ্রীর পাশাপাশি ইফতারও বিতরণ করছেন তিনি।

সফি আহমেদ জানান, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তিনি অফিসের ডিউটি করেন। তারপর মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়ে এসব খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেন। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবার প্রথম থেকেই আমাক সাহায্য করে আসছে। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন উনার ভাতা, পেনশনের সব টাকা এই উদ্যোগে দেন আমার মা। তার সঙ্গে আমার ভাই পুলিশের এসআই সুহেল অর্থ থেকে শুরু করে সব ধরণের সহযোগিতা করছেন। এছাড়া আমার বন্ধুরাও আমাকে অনেক সাহায্য করছে। তাদের কাছে আমি সারাজীবন ঋণী থাকব।’

এভাবেই খাদ্যসামগ্রীর প্যাকেট মোটরসাইকেলে ঝুলিয়ে ছুটি চলেন সফি আহমেদ

 

এই কার্যক্রম চালাতে গিয়ে অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন তিনি। এরকম একটি ঘটনাসিলেট মিররকে জানান সফি আহমেদ। তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন আগে রাতে নগরের উপশহর থেকে সাহায্য চেয়ে আমার কাছে একটি ফোন আসে। আমি যখন ঠিকানা অনুযায়ী সেখানে পৌঁছাই গিয়ে দেখি একটা বহুতল ভবন। সেই ভবনের সিকিউরিটি আমাকে প্রথমে প্রবেশ করতে দেয়নি কারণ তার মতে এই বাসায় সাহায্য নেওয়ার মত কেউ থাকার কথা নয়। তাকে অনেক বুঝালেও আমাকে ভবনের ভেতর ঢুকতে দেবে না। পরে ওই ব্যক্তিকে ফোন দিলে পরবর্তীতে ওই পরিবারের একজন নিচে নেমে সাহায্য নিয়ে যান। এরকম অনেক পরিবারের হাতেও আমি খাদ্যসামগ্রী দিয়েছি।’

এই সংকটকালীন সময়ে সমাজের সবাইকে সাধ্যমত এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন ‘যতদিন এই দুর্যোগ চলবে আমি এভাবে মানুষের পাশে থাকতে চাই। এই কাজ করতে গিয়ে আমি কিছুটাকা ঋণে পড়েছি কিন্তু মানুষের হাসির কাছে এসব কিছুই নয়।’

 

এনএইচ-০১/এএফ-১৫