সোনালী রঙে থইথই হাওর

বিশ্বজিত রায়


মে ০৩, ২০২০
০৭:৫২ অপরাহ্ন


আপডেট : মে ০৩, ২০২০
০৭:৫২ অপরাহ্ন



সোনালী রঙে থইথই হাওর

সোনালি রঙে থইথই হাওর। বাতাসে ঢেউ খেলা জমিনের সোনালি হাসি মন ভরিয়ে তুলছে। হাওরভরা এই খাদ্যশস্য বিদ্যমান অশান্ত মনে বাড়তি দোলা দিয়ে যাচ্ছে। স্বভাবতই পাকা, আধা পাকা ধানে ধ্যানমগ্ন কৃষক। এসব সাধকের প্রতি পাকা সোনালি ধানের মাথা নেড়ে নিভৃত নিবেদন-ঘরে তুলে ধন্য কর, না হলে ধান বানে ভেসে কাঁদবে; কাঁদাবে দেশ জন সকলকে। 

সোনাভরা মাঠে ফলিত এই ধানের আকুল আবেদন আটকা পড়েছে প্রকৃতিবৈরি পরিবেশ আর করোনা ভাইরাসের কারণে। কখনও কালো মেঘ, কখনও শিলাবৃষ্টি, আবার কখনও ক্ষণস্থায়ী রোদ যেমন কৃষকের শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে তেমনি করোনাক্রান্ত মহামারী পরিস্থিতি হাওরাঞ্চলকে শ্রমিক আকালের পথে ঠেলে দিয়ে একফসলী এলাকার মানুষসহ গোটা দেশকে খাদ্যঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

কভিড-১৯ করোনা পুরো পৃথিবীকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করেছে। এককথায় এক অঘোষিত যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে পৃথিবী। অনেকে একে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলে অভিহিত করছেন। তবে সে যুদ্ধ অস্ত্র দিয়ে নয়, বর্তমান সময়ে পৃথিবী যে যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছে সেটা জীবাণু যুদ্ধ বলা চলে। ভাইরাসবাহী এ জীবাণু পৃথিবীর সকল গোত্রের মানুষকে এমন এক মরণদশায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে যা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মৃত্যুময় বাস্তবতার কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে বারবার। পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যখন পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় একে অন্যের মুখোমুখী তখন মরণঘাতী করোনা তর্জনী তুলে ওই শক্তিধর রাষ্ট্র চীন, ফ্রান্স, জার্মানী, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেনসহ সকলকে সাবধানী সুর শুনিয়ে যাচ্ছে। আর আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো এর প্রভাবে সর্বাবস্থায় নতজানু হয়ে পড়েছে। দেশের ছোট-বড় শিল্প খাতসহ সকল সেক্টরে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। পাশাপাশি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কৃষি খাতও মারাত্বকভাবে করোনাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। মাথা তুলে দাঁড়ানোর যুদ্ধে সামিল হয়েছে করোনায় কাবু কৃষক ও কৃষি। প্রশ্ন জাগছে মনে-এই দুর্যোগকালে হাসবে তো হাওর।

প্রাণবিনাশী এই ভাইরাসের কারণে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন দেশের এক কোটি ৬৫ লাখ ৬২ হাজার ৯৭৪টি কৃষি পরিবার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব মতে, এসব পরিবার ধান, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করে থাকে। এর মধ্যে গ্রামে এক কোটি ৫৯ লাখ ৪৫ হাজার ১১৯টি এবং শহরে ছয় লাখ ১৭ হাজার ৮৫৫টি পরিবার রয়েছে। বাজার সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়ায় উৎপাদিত ফসল বিক্রি এবং মাঠের ফসল কাটার শ্রমিক নিয়ে চিন্তার পাশাপাশি করোনাভাইরাস সংক্রমের চিন্তাও রয়েছে এই পরিবারগুলোর। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার প্রভাব কৃষি খাতে পড়েছে। 

করোনায় স্থবির হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। আক্ষরিক অর্থে সব গৃহবন্দী। 

ক্ষেতে সোনালী ফলন। ধানকাটা শ্রমিক সঙ্কটের চিন্তা মাথায় রেখে শংকিত হৃদয়ে তারা তাকিয়ে আছে প্রকৃতির দিকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে বাড়তি যুক্ত হয়েছে করোনাকালীন দুর্যোগ। যে দুর্যোগ দুর্ভাবনায় ব্যাধিগ্রস্ত হাওর পারের অগণিত কৃষক। এ দুর্যোগকালে দেশ গৃহবন্দী থাকায় হাওরাঞ্চলে শ্রমিক সঙ্কট প্রবল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, হাওরে এবার ৪ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। সেখানকার ধান কাটতে প্রয়োজন হবে ৮৪ হাজার কৃষিশ্রমিক। হাওরের সাত জেলায় স্থানীয় শ্রমিক সর্বসাকুল্যে ১৮ শতাংশ। বাকি সব শ্রমিক বাইরে থেকে আনতে হবে। এসব শ্রমিক মিলে কাজ করলে সেখানকার সব ধান কাটতে লাগবে ২৫ দিন। [সূত্র : দেশ রূপান্তর, ২২.০৪.২০] কিন্তু করোনায় দেশ লকডাউনে থাকার ফলে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় শ্রমিক আসতে পারছে না। তাই পর্যাপ্ত শ্রমিক না থাকায় ২৫ দিনের জায়গায় কতদিন লাগতে পারে তা ঠিক করে বলা যাচ্ছে না। এ জন্য সরকারকে সঠিক পন্থা অবলম্বন করতে হবে।

তবে ধান কাটতে স্বেচ্ছায় শ্রম দেওয়া এই প্রচেষ্টা যতটা না কৃষক উপকারী তার চেয়ে বেশি আত্মপ্রচার বলেই মনে হচ্ছে। ফেসবুক খুললে এর যথার্থ প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু কিছু স্বেচ্ছাসেবক ব্যতীত অন্যদের ধান কাটার ধরণ কিংবা ছোট্ট আঁটি নিয়ে হেঁটে যাওয়ার নমুনা সম্বলিত ছবিই বলে দিচ্ছে কৃষকের উপকার কতখানি হচ্ছে। তারপরও ধরে নেব উপকৃত হচ্ছে কৃষক। হাওরে শ্রমিক সংকট ও আগাম বন্যার শঙ্কার মধ্যেই হাওরাঞ্চলে বোরো ধান কাটা চলছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী (গত ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত) সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরের গড়ে ৪২ ও হবিগঞ্জে ৩৭ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। অন্যদিকে শেরপুরে মাত্র ৬ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। এছাড়া নেত্রকোনা জেলার হাওরাঞ্চলে অর্ধেকের বেশি ধান কাটা হয়েছে বলে স্থানীয় কৃষি বিভাগ জানিয়েছে। কিন্তু স্থানীয় কৃষি অধিদপ্তরের এই হিসাব কতটা বাস্তবসম্মত সেটা বলা মুশকিল। এর মাঝেই যদি প্রকৃতি বেঁকে বসে তাহলে শুধু হাওর পারই নয়, দেশে চরম খাদ্য সঙ্কট দেখা দিবে। যেমনটা দেখা দিয়েছিল ২০১৭ সালে। তখন ছিল দুর্নীতি, এবার করোনা দুর্যোগ।

বর্তমান ফসল কাটার সময়ে এক সঙ্গে দুই দুর্যোগের মুখোমুখী কৃষক। একটা করোনাকালীন দুর্যোগ, অন্যটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। পত্রিকান্তরে খবর অনুযায়ী হাওরের সাত জেলার ৮৫ শতাংশ ধানই ঝুঁকিতে। ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত কাটা ১৫ শতাংশ ধান ছাড়া বাকি সব ধানই বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল এমনকি আগাম বন্যার কবলে পড়তে পারে। 

২০১৭ সালের হাওর ডুবির বিপর্যয় কাটিয়ে উঠলেও এবারকার বিপর্যয় কাটিয়ে উঠা অসম্ভব। কারণ খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী অনেক দেশই করোনাক্রান্ত হওয়ায় তাদের নিজেদের অবস্থাই সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়বে। করোনাউত্তর পুরো পৃথিবীই চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ার যে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা তাতে বিপদ অবশ্যাম্ভাবী। তাই আগ থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। বিপদকালীন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে সজাগ থাকতে হবে।

দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় হাওর গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। আমাদের হাওরাঞ্চল দেশের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি খাদ্য জোগান দিয়ে থাকে। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, এ বছর বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হলো ২ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন। আমাদের সারাবছরের মোট উৎপাদনের প্রায় ৫৫ ভাগের জোগান দেয় বোরো ধান। বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮-১৯ সালে দেশে মোট ধান উৎপাদন হয়েছিল ৩ দশমিক ৬৪ কোটি টন। তার মধ্যে বোরো থেকে এসেছিল শতকরা ৫৪ ভাগ, আমন থেকে ৩৪ ভাগ আর আউশ থেকে এসেছিল আট ভাগ। সবকিছু মিলে হাওরাঞ্চলের একফসলী বোরোই দেশের বৃহৎ খাদ্য চাহিদা পূরণ করে চলেছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় এড়িয়ে সঠিক ব্যবস্থাপনায় ধান ঘরে উঠানো গেলে এবং সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনায় কড়া নজরদারি থাকলে আগামী কমপক্ষে ৬ মাস খাদ্য সঙ্কটের চিন্তা থাকবে না মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে সব বিপর্যয় কাটিয়ে কৃষক ধান গোলায় তুলতে পারলে ন্যায্য প্রাপ্তি কি জুটবে কৃষকের কপালে, সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রকৃতি ও করোনা দুই দুর্যোগের কবলে পড়া কৃষক উচ্চ হারে শ্রমিক খাটিয়ে যদি ন্যায্য মূল্য না পায় তাহলে তাদের বেলায় সেই মাঠেমরা অবস্থাই হবে। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তোড়জোড় বেশ আশা জাগাচ্ছে।

করোনাকালীন বিপর্যয় সামাল দিতে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান ক্রয় করবে সরকার। মাঠপর্যায়ে এর কার্যক্রম প্রায় শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু কতটা উপকৃত হবে কৃষক? সরকার তো প্রতি বছরই ধান ক্রয় করে। সেই ধান কৃষকের বদলে সরকার দলীয় নেতাকর্মী এবং একশ্রেণির অসাধু চক্র কৌশলে সরকারি গুদামে দিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়। এই সুযোগসন্ধানী কৃষকখেকো দলটিকে আটকাতে হবে। প্রকৃত কৃষকেরা যাতে তার উৎপাদিত ধান সরকারি গুদামে দিতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে দেশে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রধান নায়ক সেই কৃষকই বঞ্চিত হবে। তাই কৃষকের কথা চিন্তা করে কৃষি খাতকে আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে। এই বঞ্চিত শ্রেণিটা যাতে আর বঞ্চিত না হয়। মনে রাখতে হবে, কৃষকই বাঁচায় প্রাণ, কৃষকই বাঁচায় দেশের মান। কৃষককে বাঁচিয়ে রাখলে দেশটাই যে বেঁচে যাবে। সেই চিন্তাটা মাথায় রেখে সামনে এগুতে হবে।

 

লেখক : সাংবাদিক