স্বদেশের চিঠি

দিলীপ রায়


মে ২৮, ২০২০
০৯:৫৭ অপরাহ্ন


আপডেট : মে ২৮, ২০২০
১০:০১ অপরাহ্ন



স্বদেশের চিঠি

সংগৃহীত

প্রিয়জনেষু,

রাঙাভূমি, অনেক দিন লেখি না তোমায়। তর্কটা আর হয়ে ওঠে না আগের মতো। 

সেদিনের ঊনসন্ধ্যার ঘনঘোর বর্ষার রিনিঝিনি বৃষ্টির কথা কি মনে পড়ে? একদল ছেলে টিটকারি মারতে মারতে হল্লা করে যাচ্ছিল। ঝুপসি চুলের আওলা ছেলেটা পারলে তোমার কানের কাছে এসে শিষ দিচ্ছিল। তুমি নাকের ডগা ফুলিয়ে বলছিলে, বাংলাদেশের ভবিষ্যত অন্ধকার এদের কারণে। আমিও অসহায়ের মতো কেবল মাথা নেড়েছিলাম। 

জানি না এদের ভবিষ্যতে কী আছে?

তবে, আজ এদের কর্মকাণ্ড দেখে অবাক না হয়ে পারা গেল না। এই করোনাকালীন সময়ে ওরা স্বেচ্ছাশ্রমে মানুষের প্রয়োজনে এগিয়ে এসেছে। ত্রাণ দিচ্ছে। দিচ্ছে ধান কেটে।

এরা কি আগামীর বাংলাদেশ নয়?

প্রিয় রাঙা,

মনে কি পড়ে তোমার ফরম ফিল-আপ এর ঘটনাটি? সেদিন মস্ত একটা অঘটনের স্বাক্ষী হয়েছিলাম? ঐ যে দলটল করে টেরা টিকু। দুর্গন্ধ আর ঘাম মিশ্রিত একটা তেলচিটচিটে শার্ট গায়ে দিয়ে ফরম জমা দিতে গিয়ে তোমার গায়ের উপর ঝুলে পড়ছিল। তুমি শুধু স্যারের কাছে নালিশ করেছিলে। ফোঁসফোঁস করে তোমাকে মারতে এসেছিল। স্যার তোমার পক্ষে কথা বলায় যাইচ্ছেতাই ব্যবহার করেছিল স্যারের সাথে।

তুমি সংক্ষুব্ধ মনে কেবল অভিশাপ দিয়েছিলে।

সেই টেরা ছেলেটা করোনায় মৃতের সৎকারে সিদ্ধহস্ত আজ। 

এর মাঝে কি বাংলাদেশ দেখতে পাও?

প্রিয়জন ভূমি,

ওই রগচটা রবিন ডাক্তারটার কথা মনে আছে ? তোমার ছোট ভাইটির দাঁত ব্যাথা। সাথে কান এবং মাথা ব্যাথা। গেলাম তোমার ভাইটিকে নিয়ে। ডাক্তারটি ভালো করে দেখলই না। শুধু বলল, দাঁতের ডাক্তার দেখাতে হবে এবং দাঁতের ডাক্তারের একটা ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিল। অথচ ভিজিট রাখলো পুরোটা। চেম্বার থেকে বের হয়ে অস্পষ্ট স্বরে কেবল বলেছিলে, কসাই একটা।

করোনার এই মহামারীর সময়ে রবিন ডাক্তারটা সবার সম্মুখে থেকে করোনাক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে।

ওর মধ্যে কি তোমার বাংলাদেশ আছে? 

প্রিয়,

তোমার বড়বোনের ডেলিভারির দিনটি নিশ্চয় মনে আছে। তিনি হসপিটালে ভর্তি। সেলাইন চলছে। হঠাৎ সেলাইনটা বন্ধ হয়ে যায়। তুমি অস্হির হয়ে ধুমকেতুর মতো ছুটে গিয়েছিলে নার্সদের রুমে। সেখানে নার্সরা একটা রোগী সম্পর্কে কি একটা মজার বিষয়ে সিরিয়াসলি আলাপে মত্ত ছিল। আর হাসতে হাসতে অকারণেই একজন আরেকজনের উপর গড়িয়ে পড়ছিল। তুমি তাগিদটা সম্ভবত কড়া ভাষায় দ্বিতীয়বার দিয়েছিলে। একটা নার্স ক্ষেপে গিয়ে তোমাকে মারতে এসেছিল।

এই নার্সটা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে আজ নিজেই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তার তিন বছরের ছোট বাচ্চাটা মাকে একটু জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে বলে দরজার সামনে গড়াগড়ি খায়। কিন্তু অসহায় মা যে কোয়ারেন্টাইনে।

এই নার্স মাকে নেবে কি তোমার বাংলাদেশ? 

প্রিয়তমাষু

কলেজের বসন্তবরণের দিনটার কথা নিশ্চয়ই ভুলে যাও নি। হলুদ শাড়ি আর সুসজ্জিত ফুলে কী অপরূপই না লাগছিল তোমাকে! আনন্দের ডামাডোলের মাঝখানে কখন যে তোমার মোবাইলটা চুরি হয়ে গেল। সে কী কান্না তোমার? সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা কি সেদিন ছিল আমার? ফোনের মাধ্যমে যেকোনো অঘটন ঘটতে পারে এইভেবে তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম থানায়। যে এসআইটা তোমার আর আমার দিকে মনে ঘেন্না ধরা নোংরা দৃষ্টিতে বারবার তাকাচ্ছিল; জিডি করতে বেশ কিছু টাকা দাবী করেছিল, সে আজ নিজের বউ বাচ্চার কথা না ভেবে রাস্তায় নেমেছে পরের ঘরের মানুষকে ভালো রাখবে বলে।

তোমার বাংলাদেশ কি ওর মধ্যে দেখতে পাও না?

প্রিয় ভুমি, 

মেজাজি, মৌরী ম্যাডামের বিষয়টি তো তোমার ভুলবার কথা নয়। ঝেঁকে পড়েছে শীত। ঠাণ্ডায় জুবুথুবু হয়ে সেদিন অনেকেই ক্লাসে উপস্হিত। ঠিক ১০টায় ছিল ক্লাস। ম্যাডাম আসলেন প্রায় ২০মিনিট লেট করে। তাও তুমি ফোন দেবার পর। প্রায়ই এরকম হয়। তুমি তো কেবল ফোনে জানতে চেয়েছিলে ক্লাসটি হবে কি না। তোমার প্রতি প্রচণ্ড আক্রোশে ম্যাডামের সেদিনের সেই রাগী চোখের চাহনির দৃশ্যটি চোখ এড়ায় নি হাই পাওয়ারের গ্লাস পরা কমজোর কমলেরও। যার কপি খাওয়ার প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করায় তোমাকে আর আমাকে জড়িয়ে বাজে কথার চটকদার লিফলেট ছাপিয়েছিল। তুমি শুধু অসময়ে পথহারা পাখির মতো একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করেছিল। 

অথচ এই করোনাকালে যখন ক্লাস বন্ধ, তখন ম্যাডাম দিনরাত এক করে অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত রাখতে প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অনেকগুলো দরিদ্র পরিবারের খাবারের নিশ্চয়তার একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

মৌরী ম্যাডামের ঠাঁই কি তোমার বাংলাদেশে হবে? 

রাঙাভূমি আমার, 

দেশটির উপর অভিমান করে অবেলার তারার মতো আর কতকাল দূরে দূরে রবে? এদেশের মানুষগুলো আসলেই ভালো। নিজের জীবন বাজি রেখে যারা অন্যের জীবনের ঝুঁকি নিতে সর্বদা প্রস্তুত, তাদের কীভাবে খারাপ বলি বলো? তাদের কেবল দরকার একটু ভালোবাসা। সেটুকু দেবার ক্ষমতা নিশ্চয়ই তোমার আছে। 

তোমার কোমলতম হৃদয়ের সবটুকু দরদ দিয়ে একটিবার ভেবে দেখো।

ভালো থেকো।

ইতি

স্বদেশ

লেখক : প্রভাষক, গণিত, মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ, সিলেট।