হিমাংশু শেখর ধর : সিলেটের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ

অজয় পাল


সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২০
০২:২২ পূর্বাহ্ন


আপডেট : সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০
১০:৪৩ অপরাহ্ন



হিমাংশু শেখর ধর : সিলেটের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ

সত্তরের ডিসেম্বর মাসে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে প্রেরিত আমার প্রথম রিপোর্টটি সিলেটের প্রাচীনতম সাপ্তাহিক যুগভেরী পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় । এটাকে যদি আমার সাংবাদিকতা জীবনের গোড়াপত্তন হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে থাকি , তাহলে ২০২০ সালের আসছে ডিসেম্বর মাসে আমার সাংবাদিকতার ৫০বছর পূর্তি হবে । এই সময়কালে সিলেটের চারটি সাপ্তাহিক সহ দেশ- বিদেশের বহু সাপ্তাহিক ও দৈনিক পত্রিকায় কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয় । এই অভিযাত্রায় সাংবাদিক হিসেবে আমার বেড়ে ওঠার পেছনে যাদের অবদান ছিলো অনস্বীকার্য , তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন আমীনূর রশীদ চৌধুরী , আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী , হিমাংশু শেখর ধর ( ঝর্ণা বাবু), সুধীরেন্দ্র বিজয় দাস ( সলুদা ) , তবারক হোসেইন ও আব্দুল বাসিত । অকপটে স্বীকার করছি , সাংবাদিকতা জীবনের সূচনা লগ্ন থেকে এ পর্যন্ত এঁদের নানা দিক-নির্দেশনা ও সহযোগিতা আমাকে সৎ ও বস্তুনিষ্ঠতার পাশাপাশি সচেতন এবং নির্ভিক হতে প্রভূত প্রেরণা যুগিয়েছে । সকলের প্রতি আমার বিনম্র কৃতজ্ঞতা ।

সিলেটের সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে সর্বশেষ কর্মস্থল ছিলো আমার ' দেশবার্তা '' । প্রথিতযশা সাংবাদিক সর্বজন শ্রদ্ধেয় হিমাংশু শেখর ধর ( ঝর্ণা বাবু ) সম্পাদিত এই কাগজে আমার '৮৩ সাল পর্যন্ত টানা দীর্ঘদিন কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিলো । দেশবার্তা'য় কাজের সুবাদে আমি কখন কিভাবে যে পিতৃতূল্য সম্পাদকের পরিবার সদস্যদের সাথে এক নিবিড় বন্ধনে জড়িয়ে যাই , তা ভাবতে গেলেই বারবার স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি । আমি নিশ্চিত , আমৃত্যু এ বন্ধন অটুট থাকবে । কখনো কোনো ছেদ পড়বে না এই বন্ধনে ।

হিমাংশু শেখর ধর । ভারতীয় লেখক- সাংবাদিকদের সম্মানে সত্তরের দশকে ''দেশবার্তা'' কার্যালয় প্রাঙ্গণে আয়োজিত সুধী সমাবেশে যুগভেরী সম্পাদক আমিনুর রশীদ চৌধুরী , সু- সাহিত্যিক মুসলিম চৌধুরী ও দেশবার্তা সম্পাদক হিমাংশু শেখর ধর সহ অন্যান্য সুধীজন । উল্লেখিত তিনজনই আজ আর বেঁচে নেই । কানাডা থেকে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ ।

এই লেখাটির উপজীব্য বিষয় কিন্তু শুধুই ''দেশবার্তা'' কিংবা পারিবারিক বিষয়- আশয় নয় , লেখাটির মূল চরিত্র হিসেবে আমি আজকের প্রজন্মের সংবাদকর্মী ও তরুণ- যুবাদের সামনে দেশবার্তা সম্পাদক হিমাংশু শেখর ধর সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরতে চাই এ কারণে যে , সিলেটের শতাধিক বর্ষের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে এই পথিকৃৎ গুণী মানুষটির অবদান সম্পর্কে অবহিত করার জন্য । কারণ , প্রচার বিমুখ এই মানুষটি সাংবাদিকতার পাশাপাশি সামাজিক ও মানবিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে আমৃত্যু যে সেবা দিয়ে গেছেন , সে তুলনায় তাঁকে নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না । অথচ এই সমাজে নিরন্তর চলছে এমন সব মানুষের বন্দনা , যারা দানের চেয়ে গ্রহণই করছেন বেশি বেশি । আর উপেক্ষিত হচ্ছেন দেশ -জাতি ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার পরীক্ষা দিয়ে আসা প্রকৃত বিদগ্ধজনেরা ।

বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের খলাগ্রাম নিবাসী এডভোকেট সুন্দরী মোহন ধর ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী প্রভাবতী ধর- এর দ্বিতীয় পুত্র হিমাংশু শেখর ধর ১৯১৯ সালের ২৬ এপ্রিল সিলেট শহরের কাষ্টঘরস্থ বাসভবনে জন্মগ্রহণ করেন ।

একুশ বছর বয়েসে অর্থাৎ ১৯৪০সালে এই সুদর্শন লম্বাটে গড়নের যুবাটি সাংবাদিকতার সাথে প্রথম যুক্ত হন । ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কোলকাতা থেকে প্রকাশিত লোক সেবক ও ভগ্নদূত পত্রিকায় সিলেট প্রতিনিধির দায়িত্ব পালনের পর ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ডন , ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব পাকিস্তান এবং ইউনাইটেড প্রেস অব পাকিস্তান- এর সিলেট প্রতিনিধির দায়িত্বপ্রাপ্ত হন এবং কাজ করেন টানা দীর্ঘদিন । ১৯৬১ সালে সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে আমিনুর রশীদ চৌধুরী সম্পাদিত সিলেটের প্রাচীনতম সাপ্তাহিক যুগভেরী ও ইংরেজি সাপ্তাহিক ইস্টার্ন হ্যারলড-এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন । এ দুটি কাগজে টানা দীর্ঘ কর্ম জীবনের পর ১৯৬৮সালে নিজ বাসভবনের সামনে সিলেট প্রিন্টার্স প্রতিষ্ঠা করে এবার নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করলেন '' সিলেট বার্তা '' । নানা ঝুঁকি সত্ত্বেও ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পত্রিকাটির সর্বশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় । মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর বাসভবন , পত্রিকা কার্যালয় সহ পুরো ছাপাখানা এবং খলা গ্রামের বাড়িটি মারাত্মক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় । এলাকার ১৩ জন নিকট আত্মীয়কেও নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় । হিমাংশু শেখর ধর এই মানসিক বিপর্যয়ের পরও দমে যাননি এতোটুকু । এই ধ্বংসস্তূপের উপরই নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ফের গড়ে তুলেন সিলেট প্রিন্টার্স এবং আবারও পত্রিকার প্রকাশনা শুরু করেন । স্বাধীন বাংলাদেশে এবার পত্রিকার নাম হলো ''দেশবার্তা ''। নতুন কাগজে সিলেট নগরীতে নির্বিচারে গণহত্যার ধারাবাহিক কলাম লিখতে শুরু করেন খোদ সম্পাদক । কলামটি দ্রুত আলোচিত হয়ে ওঠে । পরবর্তি সময়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে লিখতে গিয়ে অনেককেই এই কলামের সাহায্য নিতে দেখেছি । ১৯৯২ সাল পর্যন্ত পত্রিকাটির প্রকাশনা ছিলো অব্যাহত । কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে সে বছর চিকিৎসার জন্য হিমাংশু শেখর ধর কানাডা পাড়ি জমালে পাঠকপ্রিয় কাগজটির প্রকাশনা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় । একই দশা হয় সিলেট প্রিন্টার্সেরও । বলতেই হয় , লন্ডন পাড়ি জমানোর আগে ১৯৮৩ সাল

পর্যন্ত এই কাগজে আমার সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করার সোনালী স্মৃতি রয়েছে । প্রয়াত কবি বন্ধু মাহমুদ হকও ছিলেন আরেক সহকারী সম্পাদক । আমাদের সময়কালে এটা অফসেটে ছাপা হতো । এক সময় হু হু করে প্রচার সংখ্যাও বেড়ে যায় । এ ক্ষেত্রে চিত্রগ্রাহক আতাউর রহমান আতা এবং সিলেটের বিশিষ্ট লেখিয়েদের অবদান ছিলো শতভাগ । সম্পাদক তনয় দিবাকর ধর রাম , দীপঙ্কর ধর দীপু , দীপক ধর অপু এবং দেবাশীষ ধর গৌরাঙ্গ কাগজটির প্রচার ও মান ধরে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । সম্পাদকীয় উদার নীতির কারণে লেখকরা পত্রিকায় প্রাণ খুলে লিখতে পারতেন । এসময় কবি তুষার কর ছিলেন পত্রিকার অন্যতম নিয়মিত শক্তিমান লেখক । আর এটাও সত্য যে , কাগজের সকল লেখক ও শুভানুধ্যায়ীরা সব সময় প্রিয় সম্পাদকের কাছ থেকে পেতেন সমান সমাদর , স্নেহ- মমতা ও ভালোবাসা ।

ভারতের সদ্য প্রয়াত লেখক- সাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য ছাড়াও সিলেটের বহু রাজনৈতিক , সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এবং লেখালেখির জগতের নামি - দামী বরেণ্য ব্যক্তিদের আমি দেশবার্তা কার্যালয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা জম্পেশ আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতে দেখেছি । এ ধরনের প্রাণবন্ত আড্ডা এখনো দেশের সংবাদপত্র অফিসগুলোতে হয় কিনা আমার জানা নেই । তবে একথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি , দেশবার্তায় একসময় যারা প্রথম লিখেছেন , তারাও আজ প্রতিষ্ঠিত লেখক হিসেবে স্বীকৃত । বাকীরা স্বমহিমায় দেদীপ্যমান ।

দেশবার্তা সম্পাদক হিমাংশু শেখর ধর সিলেট প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাকালীন টানা দু'বছর সাধারণ সম্পাদক ও সহ - সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডেও নজিরবিহীন অবদান রাখেন। ১৯৬১ সাল থেকে ''৮৮ পর্যন্ত তিনি সিলেট পৌরসভার ইউনিয়ন কমিটির সদস্য ও পৌর কমিশনার হিসেবে জনগণকে সেবা দিয়ে যান । এছাড়া ১৯৬৩ থেকে ''৯০ সাল পর্যন্ত মদন মোহন কলেজ ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছাড়াও এইডেড হাই স্কুল, মির্জাজাঙ্গাল বালিকা বিদ্যালয় , রামকৃষ্ণ মিশন বালিকা বিদ্যালয় , মডেল হাই স্কুল ও কিন্ডারগার্টেন স্কুল পরিচালনা কমিটির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন । এদিকে ১৯৬১ থেকে ''৭০ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন সিলেট জেলা সংখ্যালঘু বোর্ডের অন্যতম সদস্য । সিলেট জেলা সমবায় জমি বন্ধকী ব্যাংকের সভাপতি হিসেবেও তিনি প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় নিষ্ঠার সাথে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন । এ ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করায় তৎকালীন সরকার তাঁকে যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতি প্রদান করে । সিলেটের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নিম্বার্ক আশ্রম , কালীঘাটের কালী বাড়ি, দুর্গাবাড়ি , ভোলানন্দগিরি আশ্রম , গোবিন্দ জিউর আখড়া ও রামকৃষ্ণ মিশনের সাথেও তিনি জড়িয়ে ছিলেন দীর্ঘদিন । আর ১৯৬০ সাল থেকে সিলেটের চালিবন্দর শ্মশান ঘাটের সার্বিক উন্নয়নে তিনি যে অবিস্মরনীয় অবদান রাখেন , তা নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী । এক কথায় , মানব সেবাকে তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বলেই যা কিছু মহৎ ও চির কল্যাণকর , তার জন্যে সবসময় উজানে দাঁড় বেয়ে গেছেন ।

এক জীবনে যার এতো কর্মযজ্ঞ , দেশ ও জাতিকে বিভিন্ন মাধ্যমে যিনি এতো এতো সেবা দিয়ে গেছেন , তাঁর জীবনের গল্প জানেন এই সময়ের ক'জন? আজকের সিলেটে অগণন পত্র- পত্রিকা , সংবাদকর্মী ও ফটো সাংবাদিক । এই সৃষ্টির পেছনে কারা নিরন্তর প্রেরণা যুগিয়ে গেছেন , আমরা একবারও কি তা ভেবে দেখেছি ? এই পথিকৃৎ ব্যক্তিরা যদি কালের অতলে হারিয়ে যান , তাহলে আমাদের জন্য তা হবে খুবই দুঃখ ও বেদনার বিষয় ।

২০০৫ সালে হিমাংশু শেখর ধর চিকিৎসাধীন অবস্থায় কানাডার মন্ট্রিয়েলে ৮৫ বছর বয়েসে অগণন প্রিয়জনকে কাঁদিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন । তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে বাঙলাদেশের হাইকমিশনার ও স্থানীয় মেয়রসহ অসংখ্য প্রিয়জন উপস্থিত ছিলেন । কানাডায় এখনো ঘটা করে তাঁর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী পালিত হয় । তাঁর জীবনচিত্র নিয়ে কানাডা থেকে ''মৃত্যুঞ্জয়ী হিমাংশু শেখর ধর '' শীর্ষক একখানা স্মারক গ্রন্থও প্রকাশিত হয় । অথচ নিজের জন্ম মাটি প্রিয় বাঙলাদেশে মৃত্যুর পনেরো বছর পরও তিনি যেনো এক উপেক্ষিত নাম । রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিতো দূরের কথা , নিজেকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেওয়া এই কীর্তিমান মানুষটি নিজ শহরেই যেনো আজ পরবাসী ! এ লজ্জা আমরা ঢাকবো কি দিয়ে ?

লেখক- জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক