‘ছিলোটোর লাগি আমার দুয়ার হক্কল সময় খোলা’

অজয় পাল


ডিসেম্বর ০৭, ২০২০
০৯:৪৬ পূর্বাহ্ন


আপডেট : ডিসেম্বর ০৮, ২০২০
০১:০০ পূর্বাহ্ন



‘ছিলোটোর লাগি আমার দুয়ার হক্কল সময় খোলা’

রূপালি পর্দার শক্তিমান অভিনেতা খলিল উল্লাহ খানের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। আপাদমস্তক ‘সিলেটি’ এই বরেণ্য শিল্পী ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর  হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে যান। আগে থেকেই তিনি শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছিলেন । 

প্রায় আটশ ছায়াছবি, অগণন মঞ্চ ও টিভি নাটকের অভিনেতা খলিল ছিলেন সিলেটের মুখ আলোকিত করা  ব্যক্তিত্ব এবং শ্রীভূমির অহংকার । পুরো নাম আবুল ফজল মোহাম্মদ খলিল উল্লাহ খান । ১৯৩৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সিলেট নগরের কুমারপাড়ায় জন্মগ্রহণকারী খলিল ১৯৫৯ সালে সর্বপ্রথম কলিম শরাফী ও জহির রায়হান পরিচালিত ‘সোনার কাজল’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে রূপালী জগতে পা রাখেন । আগে থেকেই দাপিয়ে অভিনয় করছিলেন মঞ্চ নাটকে । পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ের অভিনয় জীবনে একবার একুশে পদক ও দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন । এক সময় চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন । প্রথম দিকে চলচ্চিত্রে নায়ক এবং পরবর্তীতে খলনায়ক হিসেবে নিজেকে  প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রায় আটশ চলচ্চিত্রের এই শক্তিমান অভিনেতার ইন্ডাস্ট্রিতে ছিল একদম ক্লিন ইমেজ। শিক্ষাজীবন শেষ করেন সিলেটের মদন মোহন ও এমসি কলেজে।  ১৯৫১ সালে আর্মি কমিশনে যোগদান করেন। ১৯৯২ সালে আনসার ডিপার্টমেন্ট থেকে অবসরে যাওয়া খলিল দুটি চলচ্চিত্র নিজে প্রযোজনাও করেন । পরিচালক ছিলেন একটি ছবির।

সিলেটে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন প্রয়াত শক্তিমান অভিনেতা শিবু ভট্টাচার্য । খলিল তাঁকে ‘শিবে’ নামে ডাকতেন। এই শিবু ভট্টাচার্যের বদৌলতে খলিল উল্লাহ খান সিলেটে টিএন্ডটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের বহু মঞ্চ নাটকে যেমন অভিনয় করেন, তেমনি খলিলের বদৌলতে শিবু ভট্টাচার্যও অভিনয় করেন কিছু চলচ্চিত্রে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অভিনেতা খলিল যখনই সিলেট এসেছেন, আমাদের প্রান্তিক নাট্য গোষ্ঠীর মহড়া দেখতে আসতেন। সত্তরের দশকে প্রান্তিক ঢাকায় জাতীয় নাট্য উৎসবে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়। সমস্যা হলো, দলটি ঢাকায় গিয়ে উঠবে কোথায়? ঠিক সেই সময়ে খলিল উল্লাহ খান এলেন সিলেটে। শিবু’দাসহ আমরা কথা বললাম তাঁর সাথে। তাৎক্ষণিক বাড়িয়ে দিলেন সহযোগিতার হাত। শিবুদাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ছিলোটোর লাগি আমার দুয়ার হক্কল সময় খোলা। আইয়া আমার বাড়িত উঠবায়।’ সে অনুযায়ী আমরা ২০-২২ জনের দল নিয়ে তাঁর মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের বাসায় গিয়ে উঠলাম। নিচের তিনটি কক্ষ খালি করে দিলেন। কাজকর্ম বাদ দিয়ে সার্বক্ষণিক ব্যস্ত আমাদের দেখভালে। এরই মধ্যে একদিন শরীর কাঁপিয়ে আমার প্রচন্ড জ্বর উঠল। আমার ওষুধপত্রের ব্যবস্থাও তিনি নিজেই করলেন। রূপালি পর্দায় দেখেছি, দেখে অভ্যস্ত স্বপ্নের এই মানুষটির ব্যবহারে আমরা সবাই একেবারেই অভিভূত। অভিনেতা খলিল আর দশজনের মতো আমার কাছেও একদম কাছের মানুষ হয়ে গেলেন। গাল ভরে ‘খলিল ভাই’ সম্বোধন ছাড়া আর কোনো বিকল্প রইল না। এক সময় আমরা সিলেটে ফিরে এলেও খলিল ভাই আমাদের সবার হৃদয়ে দেদীপ্যমান হয়ে থেকে গেলেন। পরবর্তীতে খলিল ভাই সিলেটে যখনই এসেছেন, শিবু’দার সুবাদে আমাদের সাথে দেখা হয়েছে, আড্ডা হয়েছে। এরই মধ্যে প্রয়াত হলেন প্রান্তিক নাট্যগোষ্ঠীর প্রাণপুরুষ নাট্যপরিচালক মোমিন উদ্দিন ভূঁইয়া (সুরুজ ভাই)। আমরা তাঁর পরিবারের সাহায্যার্থে ফাণ্ড রাইজিংয়ের উদ্যোগ নিলাম। এবারও পাশে সেই খলিল ভাই। শিবু’দা আর আমাকে নিয়ে গেলেন ঢাকায় চিত্রনায়ক রাজ্জাকের বাসায়। সেখানে বসে সবকিছু চূড়ান্ত হলো। নামীদামী সব অভিনেতা এবং কন্ঠ শিল্পীদের নিয়ে  খলিল ভাই ঠিক সময়ে সিলেটে এসে হাজির। এই খলিল ভাইয়ের কারণেই বিমান ভাড়া ব্যতীত কেউ কোনো সম্মানীও নিলেন না। এই ছিলেন আমাদের খলিল উল্লাহ খান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার গ্রহণ করছেন খলিল উল্লাহ খান ।

 

খলিল ভাই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন সম্ভবত নব্বইয়ের দশকে। দিন তারিখ কিছুই এখন আর মনে নেই। তাঁর আদরের এক ছেলে দুষ্কৃতকারীদের হাতে খুন হয়। জাতীয় দৈনিকে এ নিয়ে আমি একটি রিপোর্টও করেছিলাম এবং একটি প্রচারপত্রও লিখে দিয়েছিলাম বিচারের দাবি সম্বলিত। এই হত্যাকাণ্ডের তিনি বিচার পেয়েছিলেন কিনা আমার জানা নেই। দুঃসময়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে তাঁর কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না। একবার ফোন করে ঢাকায় যেতে বললেন। আমি পুরনো ঢাকায় সরাসরি তাঁর কর্মস্থল আনসার অফিসে চলে গেলাম। তখন রমজান মাস। এক পর্যায়ে খলিল ভাই মোটর সাইকেলের পেছনে আমাকে বসিয়ে ঢাকার বিভিন্ন পথ ঘুরে ঘুরে হঠাৎ একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লেন। জেদ, আমাকে না খাইয়ে ছাড়বেন না। এই ছিলেন আমার খলিল ভাই।

এরপর আরও অনেকবার সিলেটে এসেছেন খলিল ভাই। কাষ্টঘরে শিবুদার বাসা, এমনকি ঐ এলাকার মায়া হোটেলেও শিবু’দার সাথে আমি, দিবাকর ধর রাম, মানিক লাল ঘোষ,অরিন্দম দত্ত চন্দন ও তপু চৌধুরী মিলে তাঁর সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিয়েছি। শিবু’দা প্রয়াত হওয়ার পর আর তিনি সিলেটে এসেছিলেন কিনা আমার জানা নেই। আর কখনও দেখা হয়নি তাঁর সাথে। তবে একবার টেলিফোনে কথা বলে তার কুশল জেনেছিলাম মাত্র।

২০০৬ সালে বিলেত চলে আসার পর যোগাযোগ একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । সম্ভবত ২০১২ সালে ফের একবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম। খলিল-পুত্র খালেদ খান বলেছিলো, বাবা ঘুমিয়ে আছেন। শরীরটা ভালো নেই। যোগাযোগের এই ছিলো শেষ চেষ্টা। এসবই এখন স্মৃতির সঞ্চয় মাত্র। ভালো থাকুন খলিল ভাই । ভুলব না কোনোদিন। এই লেখাটা তোমার স্মৃতির উদ্দেশ্যে আকাশের ঠিকানায় ছেড়ে দিলাম।

 

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, বর্তমানে ব্রিটেন প্রবাসী

 

এএফ/০১