রাফিদ চৌধুরী
ডিসেম্বর ১১, ২০২০
০৬:০২ পূর্বাহ্ন
আপডেট : ডিসেম্বর ১১, ২০২০
০৬:০২ পূর্বাহ্ন
সিলেটে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সিলেট সিটি করপোরেশনে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন পড়েছে ২ হাজার ৩২৭টি। যা গত বছরের মোট আবেদনের প্রায় ৮ গুণ। আবেদনকারীদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন- সামাজিক অবক্ষয় বিবাহিত জীবনে নানা প্রভাব ফেলছে। এর ফলে বিয়ে বিচ্ছেদের দিকে ঝুঁকছেন নারী-পুরুষরা। এছাড়া পুরোনা ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন না হওয়াও বিয়ে বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক শাখা সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে মেয়রের কাছে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন পড়ে ২৯৯টি। বিচ্ছেদ হয় ২৪টি। কার্যকর হওয়া ২৪টির মধ্যে ১৮টি আবেদন করেছিলেন পুরুষ, বাকি ৬টি আবেদন নারীর। এর পরের বছর থেকে বেড়ে যায় নারী আবেদনকারীর সংখ্যা। ২০১৮ সালে ২৫৭টি তালাকের আবেদনের মধ্যে কার্যকর হয় ২৯টি। যার মধ্যে ১৭টিই স্ত্রীর পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছিল। ২০১৯ সালে বিচ্ছেদের ২৯১টি আবেদনের মধ্যে কার্যকর হয় ৩১টি। যার মধ্যে ১৮টির আবেদনকারী নারী এবং বাকি ১৩টি পুরুষের।
চলতি বছর সব হিসেব ওলটপালট হয়ে যায়। অক্টোবর পর্যন্ত বিচ্ছেদের ২ হাজার ৩২৭টি আবেদন পড়ে। এসব আবেদনের মধ্যে ২২টি কার্যকর হয়েছে। যার ১৪টি আবেদনই করেন নারী। পর্যায়ক্রমে বাকি আবেদনের শুনানি শেষে সিদ্ধান্ত দেবেন মেয়র।
ডমেস্টিক ভায়োলেন্স বিষয়ক (ঘরোয়া সংহিসতা) গবেষকেরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয় ও সমাজে প্রচলিত পুরনো ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন না হওয়াই বিয়ে বিচ্ছেদের অধিক আবেদনের কারণ। এছাড়া পারিবারিক কলহ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌতুক, পরকীয়া, প্রবাসী স্বামীর সঙ্গে দীর্ঘদিনের যোগাযোগহীনতা ইত্যাদিরও প্রভাব পড়ছে দাম্পত্য জীবনে।
হঠাৎ করে আশঙ্কাজনক হারে বিয়ে বিচ্ছেদের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট সিলেটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট ইরফানুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘নারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি বিচ্ছেদের আবেদন বাড়ার অন্যতম কারণ। এক সময় নারীরা এতটা সচেতন ছিলেন না। বিয়ের পর স্বামীর সংসারের যন্ত্রণাগুলো নীরবে নিভৃতে সহ্য করতেন স্ত্রীরা। আইনি সহায়তার সুযোগ থাকলেও অনেকে তা জানতেন না। কিন্তু এখন তারা প্রচুর আইনি সহায়তা পাচ্ছেন। সুযোগগুলো নেওয়ার কারণে সেগুলো প্রচারও হচ্ছে।’
পারিবারিক কলহ, অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা ও মনোমালিন্যের কারণে মানুষ অনেকক্ষেত্রে তালাক আবেদন করতে বাধ্য হচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘উচ্চবিত্ত এবং নি¤œবিত্তের মাঝে এই সমস্যা বেশি দেখা দেয়। নি¤œবিত্তের মাঝে একাধিক বিয়ের প্রবণতা রয়েছে। সন্তান সংখ্যা বেড়ে গেলে নি¤œবিত্তের অনেক পুরুষ পালিয়ে যান। কোথায় যান কোনো হদিস পাওয়া যায় না। তখন সেই নারী সন্তানদের নিয়ে অসহায় হয়ে আইনের আশ্রয় নেন। এই কারণে নারীদের আবেদনের সংখ্যা বাড়ছে বলে আমার মনে হয়।’
শুধু সিলেট কিংবা বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর সব নগর অঞ্চলেই বিয়ে বিচ্ছেদের সংখ্যা বেড়েছে। আর এসব আবেদনের বেশিরভাগই করছেন নারীরা। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে নারীরা নিজেদের মর্যাদার বিষয়ে সচেতন হয়েছেন। আর পুরুষরা প্রাচীন মূল্যবোধ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারায় বিয়ে বিচ্ছেদ বাড়ছে বলে মনে করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক তুলসি কুমার দাস। তিনি সিলেট মিররকে বলেন, ‘সামাজিক উপাদান সংস্কৃতি (ম্যাটেরিয়াল কালচার) বদলালেও অবৈষয়িক সংস্কৃতি (নন-ম্যাটেরিয়াল কালচার) অর্থাৎ চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন না হওয়ায় বিয়ে বিচ্ছেদগুলো ঘটছে।’
তাঁর মতে, ‘আমরা মুখে বলছি সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন প্রয়োজন। সেটা হচ্ছেও। কিন্তু পরিবারের বেলায় আমরা সেই প্রাচীন মূল্যবোধে আটকে আছি।’ প্রাচীন মূল্যবোধ বলতে, স্ত্রী স্বামীর অধীনে থাকবে এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারাকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘ফলে স্বামীরা স্ত্রীর ওপর অধিকার খাটাতে গিয়ে চাপ প্রয়োগ করেন। পারিবারিক সিদ্ধান্তের বেলায় কখনও স্ত্রীর মতামতকে কোনো গুরুত্ব দেন না। এতে করে স্ত্রীরা নিজেদের মর্যাদাহীন মনে করেন। এ থেকেই তারা বিয়ে বিচ্ছেদের দিকে ধাবিত হচ্ছেন।’
মর্যাদাহীনতা অতীতেও ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অতীতে নারীর ক্ষমতায়ন সেভাবে ছিল না বলেই তারা সবকিছু মুখবুজে সহ্য করেছেন। কিন্তু এখন ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। স্ত্রীরা স্বামীর সকল কর্তৃত্ব মানবেন-এটা এই যুগে অনেকটা বেমানান।’
তিনি বলেন, ‘পড়াশোনা জানা, চাকরিজীবী নারী নিজের অধিকার সম্পর্কে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে সচেতন। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কারণেই একজন স্বচ্ছল নারী এখন সাম্য চান। যখনই বৈষম্য করা হয় তখনই পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হয়। স্বামীসহ শ^শুর বাড়ির লোকজনের মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। ফলে বাধ্য হন বিয়ে বিচ্ছেদের পথ বেছে নিতে।’
আরসি/বিএ-০১