শামস শামীম, সুনামগঞ্জ
ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০২১
১২:০৭ পূর্বাহ্ন
আপডেট : ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০২১
১২:৪৪ পূর্বাহ্ন
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার বোরো ভাণ্ডার খ্যাত ছায়ার হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধে অশুভচক্রের অশুভ ছায়া পড়েছে। অক্ষত ফসলরক্ষা বাঁধকে নড়বড়ে দেখিয়ে নতুন বাঁধের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, এই হাওরের ৬০টি প্রকল্পের অর্ধেকেরও বেশি এখনও অক্ষত রয়েছে। মূল বাঁধের উচ্চতা, স্লোব, কমপেকশনসহ প্রায় সবকিছুই দৃশ্যমান। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিশেষ সার্ভে টিম মনগড়া প্রাক্কলণ করে প্রায় ৯ কোটি ১১ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে সরকারের বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা করছে বলে কৃষকদের অভিযোগ।
গত রবিবার সরেজমিনে এই হাওরের অন্তত ২০ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে বেশিরভাগ বাঁধই অক্ষত দেখা গেছে। তাছাড়া নির্ধারিত সময়ের দেড়মাস অতিবাহিত হলেও এখনও কাজ শুরু হয়নি। রবিবার সন্ধ্যার আগে মাউতি বিলের দক্ষিণের প্রকল্পে বাঁধ থেকে এক্সকেভেটরে মাটি কেটে ওই বাঁধেই ফেলতে দেখা গেছে, যাতে বাঁধকে নতুন মনে হয়। এভাবে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের অর্থ লোপাট করতে পদে পদে অনিয়ম করতে দেখা গেছে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে।
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ছায়ার হাওরটি সুনামগঞ্জের শাল্লা, কিশোরগঞ্জের ইটনা ও নেত্রকোণার খালিয়াজুড়ি এলাকায় বিস্তৃত। তবে শাল্লা উপজেলাতেই প্রায় ৮০ ভাগ কৃষিজমি রয়েছে। ৪ হাজার ৬৩৭ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে এই হাওরে এ বছর প্রায় ৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। আবাদকৃত এই জমি থেকে প্রায় ১৮ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হওয়ার কথা, যার বাজারমূল্য প্রায় ৭২ কোটি টাকা।
শাল্লা উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছায়ার হাওরের প্রকল্প শুরু হয়েছে নোয়াগাঁও-আঙ্গারুয়া ৯৭ নম্বর প্রকল্প থেকে। শাল্লার উজানগাঁও এসে এই হাওরের ৬০টি প্রকল্প শেষ হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের শাল্লা উপজেলার উপ-সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল কাইয়ুমের নেতৃত্বে সার্ভেয়ার আব্দুল জলিল, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও নাঈম হোসেন ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে বাঁধের সার্ভে করে জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ৫৬ কিলোমিটার বাঁধের প্রাক্কলণ ব্যয় সম্পন্ন করেন। এই প্রকল্পগুলোতে ৯ কোটি ১১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে গত সপ্তাহে বরাদ্দের ৩০ ভাগ অর্থ ছাড় দেওয়া হয়েছে।
গত ৩১ জানুয়ারি ৯৭ নম্বর প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, একটি বিধ্বস্ত সেতুর পূর্বদিকে প্রায় অক্ষত বাঁধ রয়ে গেছে। এই প্রকল্পের উত্তর-পশ্চিমের মাথার অংশে ৭-৮ হাত দৈর্ঘ্য ভাঙা। কিন্তু এই প্রকল্পেও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। এর পাশেই আঙ্গাউরা ৩০ মিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট সেতুর মুখ বন্ধ করতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা।
এরপর শাল্লা কলেজের পেছনের সেতুর নিচ থেকে শুরু হয়েছে ছায়ার হাওরের প্রকল্পগুলো। সেতুর নিচ থেকে দাড়াইন নদীর তীর ধরে অন্তত ২০ কিলোমিটার ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ বাঁধেরই অবকাঠামো অক্ষত রয়েছে। এখনও মূল কাঠামোতে বিদ্যমান বাঁধগুলো। কিন্তু বেশিরভাগ প্রকল্পেই অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে এভাবে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাট করার চেষ্টা দেখা গেছে পদে পদে। হাওরের ৯৭ নম্বর প্রকল্প থেকে ১৫৬ নম্বর প্রকল্প পর্যন্ত সরকারি বরাদ্দ লোপাটের সুযোগ করে দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। শুধু বরাদ্দ নয়ছয়ই নয়, প্রকল্প অনুমোদনেও দুর্নীতি ও অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। হাওরে জমি নেই, বাঁধ এলাকার কৃষক নয়- এমন একাধিক প্রকল্পও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে। এসব নিয়ে জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্থানে অনিয়ম ও দুর্নীতিরও লিখিত অভিযোগ করেছেন কৃষকরা।
সুলতানপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাবিবুর রহমান বলেন, 'শাল্লা কলেজের পেছনের দাড়াইন নদী থেকে শুরু করে ছায়ার হাওরের বেশিরভাগ প্রকল্পই অক্ষত। মূল অবকাঠামোতেই আছে বাঁধ। কিন্তু যেভাবে অতিরিক্ত বিপুল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তাতে সরকারি অর্থ লোপাটের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এতে আমাদের সরকারের ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন হচ্ছে।'
শাল্লা উপজেলার আঙ্গাউড়া গ্রামের কৃষক শনি দাস বলেন, 'আমাদের এলাকায় দুটি প্রকল্প দেওয়া হয়েছে। দুটিতেই অধিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যেখানে ১ থেকে ২ লাখ টাকা দিলেই হতো, সেখানে দেওয়া হয়েছে প্রায় ২০ লাখ টাকা। সরকারি অর্থ কীভাবে লুটপাট হচ্ছে এটা তার বড় একটা উদাহরণ।'
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের শাল্লা উপজেলা শাখার সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা দুর্গাচরণ দাস বলেন, 'শুধু ছায়ার হাওরেই নয়, শাল্লার সবগুলো উপজেলাতেই অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন, গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ধাপে ধাপে অনিয়ম ও দুর্নীতি রয়েছে। তার ওপর এখনও কাজ শুরু হয়নি। কখন তারা কাজ শুরু করবে এটা নিয়ে আমরা চিন্তিত আছি।'
পানি উন্নয়ন বোর্ড শাল্লা উপজেলার উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আব্দুল কাইয়ুম বলেন, 'এ বছর বন্যার কারণে পানি বিলম্বে নামায় প্রাক্কলণ করতে বিলম্ব হয়েছে। তাছাড়া উপজেলা কমিটিও প্রকল্প অনুমোদন দিতে বিলম্ব করেছে। তবে দুই-একদিনের মধ্যেই কাজ শুরু হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সার্ভে টিমের প্রাক্কলণেই বরাদ্দ বন্টন হয়েছে। এতে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়নি।'
এসএস/আরআর-০১