অপরিকল্পিত নদী খনন : ৫ কোটি টাকা জলে যাওয়ার শঙ্কা

আলী আহমদ, জগন্নাথপুর


মার্চ ২৩, ২০২১
১১:৪৩ অপরাহ্ন


আপডেট : মার্চ ২৫, ২০২১
১২:২৬ পূর্বাহ্ন



অপরিকল্পিত নদী খনন : ৫ কোটি টাকা জলে যাওয়ার শঙ্কা

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের নলজুর নদী অপরিকল্পিতভাবে খননের কারণে নদী যেন এখন এলাকাবাসীর গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুফলের বদলে নানা সমস্যার পাহাড় হয়ে দাঁড়াবে নদী- এমন আশঙ্কা স্থানীয়দের। ফলে খননকাজে সরকারি বরাদ্দকৃত ৫ কোটি টাকা জলে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে নদীটি খালের ন্যায় করা হচ্ছে। এতে করে বর্ষায় শত শত নৌযান চলাচলে চরম বিঘ্ন সৃষ্টি হবে। ব্যাহত হবে হাওরের বোরো ফসল গোলায় উঠানোর কার্যক্রম। এছাড়া খননের মাটি পাশে রাখায় মাটিগুলো বৃষ্টিতে ভেসে গিয়ে নদীতে পড়বে। এজন্য নদী খনন পুরোপুরি উপকারিতার বদলে তা উপজেলাবাসীর গলার কাঁটা হতে পারে।

এদিকে, নদীতে খননের কাজ শুরু হওয়ায় বসতভিটা হারানোর ভয়ে দিন-রাত কাটছে এখানকার বৈধ বাসিন্দাদের। অন্যদিকে বহাল তবিয়তে আছেন নদীর দুইপাড়ের অবৈধ দখলদাররা। এসব অভিযোগ স্থানীয়দের।

স্থানীয়রা জানান, জগন্নাথপুর সদর বাজার দিয়ে বয়ে যাওয়া নলজুর নদীটি একসময় ব্যবসায়ীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। এ নদী দিয়ে মালবাহী বৃহদাকারের নৌকায় ন্যূনতম যাতায়াত ব্যয়ে রাজধানী ঢাকা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, আজমিরীগঞ্জ, শিল্পনগরী ছাতকসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা থেকে সহজে মালামাল পরিবহন করা যেত। নদীটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা এ ধরনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। নদী ভরাট হয়ে শুধু নাব্যতাই হারায়নি, নদীর দুইপাশে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। এর মধ্যে নামে-বেনামে নদীপাড়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে অফিস, দোকান, আবাসিক হোটেল, বাড়ি-ঘরসহ স্থায়ী-অস্থায়ী বিভিন্ন স্থাপনা। দীর্ঘদিন ধরে এলাকাবাসী নদী খননের দাবি জানিয়ে এলে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবার নদী খননের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু খননের শুরুতেই অভিযোগ উঠেছে দায়সারাভাবে খননকাজের। বড় নদীকে ছোট করে দেওয়া হচ্ছে। নদীর পথ পরিবর্তন করে মালিকানাধীন বসতভিটার পাশ দিয়ে খননকাজ শুরু করলে স্থানীয়দের বাধার মুখে পড়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এছাড়া জগন্নাথপুরের হাসিনাবাদ ও জগন্নাথপুর এলাকার কয়েকজন কৃষকের ফসলি জমি কেটে দেওয়া হয়েছে বলে কৃষকরা অভিযোগ করেছেন।

তারা জানান, নদীটি ছোট খালের ন্যায় রূপ নেওয়ায় শত শত নৌকাসহ নৌযান চলাচল হুমকির মুখে পড়বে। উপজেলা সদরের পরিষদ এলাকায় নৌকাঘাট অচল হয়ে পড়বে। নদীটি ছোট হয়ে যাওয়ায় যাত্রীবাহী ইঞ্জিন নৌকাসহ সকল ধরনের বড় নৌযানের চলাচল ব্যাহত হবে।

নৌকাঘাটের ইজারাদার জগন্নাথপুর বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহির উদ্দিন বলেন, 'বিশাল বড় নদী এখন ছোট খালের মতো রূপ নিয়েছে। এজন্য বর্ষা মৌসুমে নৌকা চলাচল করতে পারবে না। এই ঘাটে তিন থেকে চার শতাধিক ইঞ্জিনচালিত যাত্রীবাহী নৌকা আসে। এসব নৌকায় জগন্নাথপুরের হাওরাঞ্চলের চিলাউড়া-হলদিপুর, রানীগঞ্জ, আশারাকান্দি ও পাইলগাঁও ইউনিয়নের লাখো মানুষ নলজুর নদী হয়ে উপজেলা সদরে যাতায়াত করেন। এছাড়া জগন্নাথপুরের সঙ্গে ময়মনসিংহের নেত্রকোনা ও মদন থেকে নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। এতে করে হাওরপাড়ের মানুষ নৌপথে চলাচলে চরম সমস্যায় পড়বেন।'

নলজুর নদীর পার্শ্ববর্তী বাসিন্দা পৌরশহরের ইকড়ছই হাসিনাবাদ এলাকার দরিদ্র আজাদ আলী বলেন, 'নদীর পথ পরিবর্তন করে নদী খননের জন্য হাসিনাবাদ ও জগন্নাথপুর এলাকার ১৫ থেকে ২০টি পরিবারের মালিকানাধীন ভিটা কেটে দেওয়া হয়েছে। হুমকির মধ্যে আছে আমাদের বসতভিটা। সম্প্রতি মাথাগোঁজার বসতবাড়ির ভিটায় খননকাজ শুরু করলে স্থানীয়দের বাধার মুখে ঠিকাদার কাজ করতে পারেননি। বর্তমানে বসতভিটা হারানোর ভয়ে আমাদের চোখে ঘুম নেই।'

পিংলার হাওরের কৃষক জলিল মিয়া বলেন, 'নলজুর নদীর তীরবর্তী এলাকায় অবস্থিত জগন্নাথপুরের অন্যতম হাওর পিংলার হাওর। নদী খননেন নামে অপরিকল্পিতভাবে খননে মাটি হাওরের যাতায়াত রাস্তায় ফেলে রেখে চলাচলের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এরকম অবস্থা থাকলে হাওরের পাকা ফসল ঘরে তোলা দুরূহ হয়ে উঠবে কৃষকদের জন্য।'

এদিকে সাম্প্রতিককালে জগন্নাথপুর উপজেলার মাসিক সমন্বয় সভায় স্থানীয় জনপ্রতিধিরা অপরিকল্পিত খননকাজে ক্ষোভ প্রকাশ করে দ্রুত এই কাজ বন্ধ করে পরিকল্পিত খননের দাবি তুলেছেন।

জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান বলেন, 'নলজুর নদীতে নতুন নকশা অনুযায়ী ২২০ ফুট প্রস্থ রয়েছে। কিন্তু নকশা অনুযায়ী খনন না করায় নদী খালে পরিণত হচ্ছে। এই খননকাজে উপজেলাবাসী কোনো সুফল পাবেন না। উল্টো নানা সমস্যায় পড়বেন এলাকাবাসী। সরকারি টাকার অপচয় রোধ করতে অপরিকল্পিত নদী খননের বিষয়টি আমরা জোরালোভাবে দেখে পরিকল্পিত নদী খননের দাবি জানিয়েছি।'

পানি উন্নয়ন বোর্ড জগন্নাথপুর উপজেলা কার্যালয় সূত্র জানায়, উপজেলা সদরের বাদাউড়া থেকে এরালিয়া বাজার পর্যন্ত সাড়ে ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৫০ ফুট প্রস্থে নদীখননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনটেক লিমিটেড, ঢাকা সাড়ে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দে কাজ বাস্তবায়ন করছে। গত ১৮ জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু হয়েছে। আগামী ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জগন্নাথপুর উপজেলা কার্যালয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী হাসান গাজী বলেন, 'পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদীখননের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রকৌশলীর নকশা ও প্রাক্কলন অনুযায়ী নদী খননের কাজ হচ্ছে। আমরা কাজ তদারকি করছি।'

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী কামরুজ্জামান খান বলেন, 'প্রাক্কলন অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। নদীর অপর অংশে ৩৫ মিটার নিচে ১৫ মিটার খনন হবে। নদীর দুইপাশে বাঁধের মতো হবে।'

জগন্নাথপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মেহেদী হাসান বলেন, 'সদ্য অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদের সভায় জনপ্রতিনিধিরা নলজুর নদী খনন নিয়ে আলোচনা করে দাবি জানিয়েছেন নদীটি নতুন নকশা অনুযায়ী খনন করতে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে জেলা নদী রক্ষা কমিটিতে লিখিত আবেদন করব আমি। এছাড়া নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'

 

এএ/আরআর-০২