ধানের সাগর শনির হাওর

শামস শামীম, সুনামগঞ্জ


এপ্রিল ২৪, ২০২১
১০:৪৩ অপরাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ২৪, ২০২১
১১:৩৯ অপরাহ্ন



ধানের সাগর শনির হাওর

সূর্য ও ছায়ার ছেলে শনি। তেজে বলিয়ান এক তপস্বী। স্ত্রী ঋতুস্নান শেষে স্বামীসঙ্গ পেতে উদগ্রীব। কিন্তু ধ্যানমগ্ন শনি ফিরেও তাকান না চিত্ররথের সুন্দরী কন্যার দিকে। ক্ষুব্ধ স্ত্রী শাপ দেন, শনি যার দিকে তাকাবেন তিনি বিনষ্ট হবেন। হয়ও তাই। এই শনি কালিকাপুরাণ, সাম্ব পুরাণ, অগ্নিপুরাণে একই আবহে নানা রঙে চিত্রিত হয়েছেন। সুনামগঞ্জের ধানের সাগর খ্যাত শনির হাওরও সোনার ধান নিয়ে খেয়ালি প্রকৃতির কাছে মাঝে-মধ্যে হেরে যায়। শনির বিরূপ দৃষ্টি যেন পড়ে হাওরে। তখন হাওরবাসী হাহাকার করেন। কিন্তু এবার মৌসুম ভালো থাকায় কাঙ্ক্ষিত ফলন হয়েছে হাওরে। হলুদরঙা ধানের সাগরে রূপ নিয়েছে শনি। সেখানে উদয়াস্ত কাস্তে, ওকন, টুকরি, বস্তা হাতে ব্যস্ত লাখো কিষাণ-কিষাণী। শ্রমিকদের নিয়ে হাওরে ব্যস্ত কৃষকরা। তাদের স্ত্রী-কন্যারা ব্যস্ত ধানখলায় ধান শুকানো ও গোলায় তোলা নিয়ে।

তিনটি উপজেলা নিয়ে বিস্তার শনির হাওরের। জমির পরিমাণ বেশি হওয়ায় এটি তাহিরপুর উপজেলার হাওর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তবে বিশ্বম্ভরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলায়ও এই হাওরের বেশ কিছু জমি রয়েছে। হাওরের চারদিকে এখন বিস্তৃত ধানক্ষেতে হাওয়ার ঢেউ। দৃষ্টির সীমানায় কেবল ধান আর ধান। কখনও কখনও কালবৈশাখীর চোখরাঙানি আর শিলার রূপ দেখে বিচলিত হচ্ছেন কৃষকরা। হাওরঘেঁষা মেঘালয় থেকে নেমে আসা আগ্রাসী ঢলের কম্পনও কানে শীষ কেটে ভয় দেখাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই নোনা ঘাম ঝরানো একমাত্র ফসল গোলায় তুলতে এখন লাখো কৃষক অস্থির সময় পার করছেন হাওরে। জেলা এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও বংশ পরম্পরায়ও মৌসুমী শ্রমিকরা ধান কাটতে এসেছেন হাওরে। ধান কেটে তারা বছরের খোরাক সংগ্রহ করে ফিরবেন বাড়ি। কৃষক ও শ্রমিকের মুখজুড়ে থাকবে হাসি।

সুনামগঞ্জ কৃষি বিভাগের মতে, শনির হাওরে আবাদ হয়েছে ১৪ হাজার ৩০ হেক্টর জমি। হাইব্রিড, উফশি ও স্থানীয় জাতের ধানও চাষ করেছেন কৃষকরা। কৃষি বিভাগের মতে এই শনির হাওরে উৎপাদিত ধানের মূল্য প্রায় ২শ কোটি টাকা। তাহিরপুরে শনির হাওরে ৬ হাজার, বিশ্বম্ভরপুরে ১ হাজার ৩০০ এবং জামালগঞ্জে ৬৪০ হেক্টর জমি রয়েছে। এছাড়া এই হাওরে সব মিলিয়ে আবাদ হয়েছে ১৪ হাজার ৩০ হেক্টর বোরো জমি। গড় উৎপাদন হেক্টরপ্রতি প্রায় ৪.০২ মেট্রিক টন চাল।

গত সোমবার দুপুরে তাহিরপুর এলাকার শনির হাওরের ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, দলে দলে ধান কাটছেন শ্রমিকরা। কৃষক জাঙ্গালে দাঁড়িয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন এবং কাজে সহযোগিতা করছেন। হাওরের উত্তর-দক্ষিণমুখী (ধান পরিবহন ও চাষাবাদ করার সময়ে ব্যবহারের একমাত্র রাস্তা) কয়েকটি গোপাট ঘুরে দেখা গেছে চারদিকেই বিস্তৃত পাকা ধানক্ষেত। সবদিকেই ধান কাটছেন হাজারও শ্রমিক। কেউ খোলা গলায় গান গেয়ে ধান কাটছেন, কেউ বা মোবাইল ফোনে গান বাজিয়ে গানের তালে মনোনিবেশ করে ধান কাটছেন। অন্যদিকে তাকানোর সময় নেই তাদের। আসন্ন বিপদের কথা আঁচ করতে পেরে সবাই ধান কাটায় বিভোর। কাটা ধান অটোরিকশা ও গরু-মহিষের গাড়ি দিয়ে খলায় আনছেন কৃষক ও তাদের সন্তানরা। জাঙ্গালে খলায় খড় শুকাচ্ছেন গবাদি পশুকে খাওয়াতে। প্রতিটি গোপাটেও ভিড়। উজান তাহিরপুরের দক্ষিণমুখী গোপাট দিয়ে প্রবেশ করে জামালগঞ্জের বেহেলিমুখী গোপাটে গিয়ে দেখা যায়, সেই এলাকায়ও কাজ করছেন কৃষকরা। বিশাল হাওরের কোনো কূলকিনারা দেখা যাচ্ছে না। শুধুই বিস্তৃত ধানক্ষেত। ঘুরে ঘুরে ভাটি তাহিরপুরের উত্তরমুখী গোপাট দিয়ে প্রবেশ করে দেখা গেল খলায় শত শত কিষাণ-কিষাণী সন্তান-সন্ততি নিয়ে কাজ করছেন। 

মধ্য তাহিরপুর গ্রামের কৃষক আয়ূব আলী (৫৫) এ বছর প্রায় ৬ একর জমিতে ধান লাগিয়েছেন। এখন ধান কাটছেন শ্রমিকরা। গত ৫ বছর ধরে তার ক্ষেতের ধান কেটে দিতে আসছেন একই উপজেলার বিন্নাকুলির শ্রমিকরা। গোপাটে দাঁড়িয়ে তিনি শ্রমিকদের নির্দেশনার সঙ্গে ধানির মুঠি টানার কাজও করছেন।

শ্রমিক আব্দুর রাজ্জাক গত ৪০ বছর ধরে শনির হাওরে ধান কাটছেন। তাকে তার পিতা এই হাওরে কিশোর বয়সে ধান কাটতে নিয়ে এসেছিলেন। এখন তিনিও তার ছেলে ফসিউল আলমকে ধান কাটতে নিয়ে এসেছেন। গত ১০ বছর ধরে বাবার সঙ্গে হাওরে ধান কাটতে আসছেন ফসিউল। একই এলাকার শ্রমিক নূর আলমও গত ২০ বছর ধরে ধান কাটতে আসছেন শনির হাওরে। তার সঙ্গে এখন তার ছেলে নজরুল ইসলামও ধান কাটতে এসেছেন। পাশেই আরেকটি ক্ষেতে তাহিরপুর উপজেলার পঞ্চাশোর্ধ শ্রমিক মধু মিয়া হাওরে ধান কাটতে এসেছেন। ধান কাটায় সঙ্গে নিয়ে এসেছেন ছেলে আজিজুল হককে। তিনিও পিতার হাত ধরে ৩০ বছর আগে এভাবে ধান কাটতে এসেছিলেন।

শ্রমিকরা জানালেন, মৌসুম ভালো হলে হাওরে ধান কাটতে পারলে অন্তত ৬ মাসের খোরাকি সংগ্রহ করেন তারা। তখন নিশ্চিন্তে বসে ঘরের ভাত খেতে পারেন। সাত হিস্যায় ধান কাটেন তারা। ছয় টুকরি ধান মালিকের হিসেবে ফেলে এক টুকরি ধান তাদের ভাগে ফেলা হয়। প্রতিদিন প্রায় ১ মণের কাছাকাছি ধান ভাগে পাওয়া যায়। দশ দিনের মধ্যেই শেষ হবে এই হাওরের ধান কাটা।

শ্রমিক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘বাপে হাতে ধইরা ৪০ বছর আগে ধান কাটায় নিয়া আইছিল। অনে আমিও আমার পুতরে লইয়া ধান কাটতে আইছি। ঠিকমতো ধান কাটতে পারলে ৬ মাস ঘরো বইয়া খাওন যাইব।’ 

শ্রমিক নূর আলম বলেন, ‘বৈশাখও দিন মাদান বালা থাকে না। যে কোনো সময় তুফান, ঠাঠা (বজ্রপাত) আইতে পারে। এতে আউরো ধান কাটার শ্রমিকরা মারা যায়। তার বাদেও পেটের জ্বালায় আমরা আসি। সরকার যদি ঠাঠা বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতো তাইলে শ্রমিকরাও বাঁচতো। কৃষকরাও ধান কাটা নিয়া চিন্তায় থাকত না।’

জমির মালিক আয়ূব আলী বলেন, ‘শনির আওর আমরার আশীর্বাদ এবং অভিশাপেরও নাম। তবে গত দুই বছর ধইরা আশীর্বাদ দিছে শনি। আওর ভইরা ধান দিছে। হেই ধান তুলতাম পারছি। ইবারও দিন মাদান বালা থাকায় মনে অয় সব ধান তুলতাম পারমু। ইই ধানের উফরেই আমরার বাইচ্চা থাকা, বিয়া-শাদি-লেখাপড়া আর জীবন ধারনের সব খরচ করি। ধান মাইর গেলে আমরার কান্না কেউ দেখার নাই।’

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ফরিদুল হাসান বলেন, ‘মৌসুমে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় ফলন কিছুটা কম হলেও কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন হয়েছে। আমাদের গড় উৎপাদন হেক্টরপ্রতি প্রায় ৪.০২ মেট্রিক টন চাল। শনির হাওর জেলার অন্যতম বড় হাওর। তিনটি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত এই হাওরে এবার ধান ভালো হয়েছে। অর্ধেকের কাছাকাছি ধান ইতোমধ্যে কাটা হয়ে গেছে। এ মাসের মধ্যেই প্রায় সব ধান কাটা শেষ হবে।’

 

এসএস/আরআর-০৩