ঈদের চাঁদ দেখা

সেলিম আউয়াল


মে ১৪, ২০২১
০৭:৪৫ অপরাহ্ন


আপডেট : মে ১৪, ২০২১
০৭:৪৫ অপরাহ্ন



ঈদের চাঁদ দেখা

‘বিরাট সবুজ একটা মাঠ। পাশে একটা ছোট্ট গোরস্তান, গা ঘেঁষে একটি হলুদ রংয়ের সরকারি কলোনি। মাঠটা কলোনির। চারপাশে কাঁঁটাতারের বেড়া। কিন্তু এখন আর সেগুলো নেই। দুষ্টু ছেলেরা কাঁটাতারের বেড়ার কংক্রিটের খুঁটিগুলো ভেঙে ফেলেছে। খুঁটির ভেতরের লোহা বেচে চমচম খায়। মাঠের দু-পাশে সারবাঁধা ছোট ছোট ঝুপড়ি। চাল বেয়ে ধুয়া উঠেছে। গোরস্তানের সোজাসুজি মাঠের অপর পাশটা ধপাস করে নিচে নেমে গেছে। গোরস্তানের পাশে দাঁড়িয়ে মাঠের নেমে যাওয়া অংশের ঘরবাড়ি দেখা যায় না, গাছগাছালির আগা একটু আধটু দেখা যায়। অনেক অনেক দূরে পাহাড়, পাহাড়ের গা ঘেঁষে সাদা সাদা বাড়ি, বড় বড় বৈদ্যুতিক খুঁটি। সন্ধ্যার বেগুনি অন্ধকারে ছাওয়া মাঠটায় প্রচণ্ড হইহুল্লোড়। প্রতিদিনের সেই নীরবতাটুকু কাঁচের বাসনের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, শিশু বুড়ো আর যুবাদের হইচই-এ। কলোনির গুচ্ছ গুচ্ছ শিশু-বুড়ো সারা মাঠটায় ছড়িয়ে। আকাশে কালো মেঘের ভেলা। শাঁ শাঁ করে বাতাস ছুটে চলেছে। টুকরো টুকরো মেঘের ফাঁক দিয়ে এক চিলতে সোনালি মতন চাঁদ দেখবে মাঠে আসা শিশু-বুড়ো। ঈদের চাঁদ। ছোটরা ইফতার সেরেই চলে এসেছে চাঁদ দেখতে। কিন্তু মেঘগুলোর জ্বালায় চাঁদের পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। গাছপালার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে কত উঁকিঝুঁকি।

দুষ্টুরা আবার এই ফাঁকে মজা করে নিচ্ছে। গাছের ফাঁক ঝোঁপের দিকে আঙুল দেখিয়ে ‘ওই যে চাঁদ দেখা যায়’ বলতেই সবাই তার পাশে ভিড় জমায় আর সে তখন হা হা হাসিতে ফেটে পড়ে। কেউ কেউ আবার রেগে যায়। গোল গোল চোখ লাল হয়ে ওঠে।’ 

কথার এই চিত্রটা ‘ধূসর পায়রার ঝাঁক’ নামে আমার একটি গল্পের সূচনা, এটি ১৯৮৪ সালে লেখা। গল্পটা এইভাবে এগিয়ে গিয়ে বস্তির এক কিশোরের জীবনের বেদনার কাহিনি। তবে ঈদের চাঁদ দেখার পুরো এই দৃশ্যের হইচই করা শিশুদের একজন ছিলাম আমিও।

তখন আমরা সিলেট শহরের আম্বরখানা সরকারি কলোনিতে বাস করি। এটি ছিল ওসমানী বিমানবন্দর সড়কের পাশের সরকারি কর্মচারীদের কোয়ার্টার। রমজানের রোজার শেষে ঈদের এক ফালি চাঁদ দেখার জন্য আমরা এইভাবে কলোনির পশ্চিমের মাঠটিতে ভিড় করতাম। মাঠটিতে এক সময় ছিল জঙ্গল। তারপর জঙ্গল-ঝোঁপঝাড় কেটে শবজি আবাদ হয়েছিল। এখন সবজি ক্ষেত নেই। কলোনির মাঠটি আছে, কিন্তু মাঠের দক্ষিণের পাবলিকের টিলাটি কেটে ঘরদোর হয়েছে, আর তাই মাঠটিও ধ্বসে যাচ্ছে। আমরা দল বেঁধে সেই মাঠে যেতাম। একা যেতে ভয় হতো। মাঠের পথে ছিল বাঁশঝাড়ে ছাওয়া একটি গোরস্তান। গা ছম ছম করতো। সময়টা সম্ভবত চুয়াত্তর-পঁচাত্তর হবে।

আকাশের গায়ে বাঁকা চাঁদের দেখা পাবার পরই চারপাশে নামতো আনন্দের বন্যা। আমাদের কলোনির মুরব্বিরা চাঁদের দেখা পেয়ে হাত তুলে দোয়া করতেন। হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর দরগাহ শরিফ আমাদের কলোনি থেকে হাফ কিলোমিটার দূরে হবে। চাঁদ দেখার পর দরগায় ঢোল বাজানো হতো। ঢোলের আওয়াজটা প্রচলিত আওয়াজের মতো নয়, মনে হতো ঢোলের গায়ে কে যেন বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পেটাচ্ছে। দরগাহে বাজানো ডোলের মতো বাদ্যযন্ত্রটার নাম নাকাড়া। কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতায় আছেবেজেছে নাকাড়া, হাঁকে নকিবের তূর্য...’। দরগাহর নাকাড়াখানা থেকে বেজে উঠতো নাকাড়ার শব্দ। আমাদের কলোনি থেকে নাকাড়ার শব্দ শোনা যেতো। চাঁদ দেখার পর দরগাহে নাকাড়া বাজানোর প্রচলন অনেক পুরোনো। আগে শহরে এতো দালান-কোঠা ছিল না, তখন নাকি নাকাড়ার শব্দ শহরের অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ত। আমাদের শৈশবে নাকাড়ার পাশাপাশি সাইরেনেরও প্রচলন হয়েছে, এজন্যে সেই সময়ে চাঁদ দেখার পর নাকাড়ার শব্দ ছাপিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে বেজে উঠত সাইরেনের ভো আওয়াজ।

কখনও আকাশ মেঘলা থাকায় চাঁদ দেখা যেত না। আমাদের মন খারাপ হয়ে যেত। তখন দেখতাম বড়রা কেউ কেউ মাঠে রেডিও নিয়ে এসেছেন। ড্রাইসেল ব্যাটারি দিয়ে রেডিও বাজানো হতো। রেডিও-র লম্বা এন্টিনা টাঙিয়ে তারা সারা মাঠ হেঁটে হেঁটে রেডিওর বিভিন্ন স্টেশন ধরে চাঁদ দেখার খবর খুঁজতেন। অনেক সময় দেখা যেত, আমাদের মাঠে চাঁদ দেখা না গেলেও দেশের অন্য কোনও জেলায় হয়তো চাঁদ দেখা গেছে, তখন রেডিওর ঘোষণা থাকতো‘শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেছে, আগামীকাল পবিত্র ঈদুল ফিতর...।’

তারপর মাঠ থেকে হইচই করে বাসায় ফিরতাম। 

বাসায় আম্মা তখন ঈদের নাস্তা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। তখন নাস্তার আইটেম ছিল হাতেগোনা, কমন আইটেম ছিলনারকেলের পপ, সন্দেশ, লাচ্ছা সেমাই। আমাদের আশেপাশের বাসার অনেকে চালের গুঁড়ি দিয়ে রমজানের শেষের দিকে হাতে সেমাই বানাতেন। সেসব সেমাই ঈদের দিন আমাদের বাসায় তারা পাঠাত। তাদের প্রায় সবার বাড়ি ছিল সিলেটের বাইরে। আমাদের কলোনিতে সিলেটের লোকজন যারা ছিল, এসব হাতের সেমাইটেমাই তারা খুব একটা বানাতো না। পরবর্তীকালে আমার বোনেরা বড় হলো, ওরা ডুনাট চটপটি বানাত। আখনি তেহারি বানাত। আরও কত রকমের নাস্তা নিয়ে গবেষণা। পত্রিকা থেকে নাস্তাররেসিপি কেটে নাস্তা বানানোর কসরত।