আল আজাদ
মে ১৫, ২০২১
১০:৫১ অপরাহ্ন
আপডেট : মে ১৫, ২০২১
১০:৫১ অপরাহ্ন
একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই আমার দুটি সংসার। একটি ঘরে, আরেকটি বাইরে। যেমনি বাবা-মা কোনওদিন কিছু চাননি, তেমনি ভাই-বোনেরাও। স্ত্রী-সন্তানদের কিছু দিতে চাইলেও নিতে চায় না। যা নেয়, তা ঈদের বিশেষ কিছু মনে করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। উল্টো আমার কিছু দরকার আছে কি না, সেটা নিয়েই সবার যত ভাবনা। তারা জানে, ঈদে ঘরের চেয়ে বাইরের সংসার অর্থাৎ কর্মস্থল নিয়ে আমি খুব বেশি ভাবনায় থাকি। থাকতে হয়। নিজের হাতে গড়া এসব প্রতিষ্ঠানে সবসময়ই কিছু কর্মী-সহকর্মী থাকে। তাই তাদের ন্যূনতম চাহিদা পূরণের মাঝেই ঈদের আনন্দ খোঁজার চেষ্টা করি। এই আনন্দ প্রাপ্তিতে কখনও পূর্ণতা থাকে। আবার কখনও কখনও অতৃপ্তির যন্ত্রণায় কাতরাই। তবুও ঈদ মনকে নাড়া দেয়। দিনটিকে অন্যরকম মনে হয়।
কয়েকবছর আগে পর্যন্ত ঈদের জামাতে নামাজ আদায় করেই পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাইরে ছুটে যেতে হতো। এখন বাইরে না গেলেও ঘরে বসে কাজ করতে হয়। অন্যদিনের চেয়ে এদিন কাজে আলাদা একটা টান অনুভব করি। কখন যে দিন পার হয়ে যায় বুঝতেই পারি না। এ ছাড়া ঈদের দিনে দুটি কাজ অবশ্যই করণীয় থাকে। একটি হলো বাবা-মা সহ প্রিয়জনদের কবর জিয়ারত আর অপরটি মাথার উপর ছায়া হয়ে থাকা বড়বোন শাহানারা ইয়াসমিনের পা ছুঁয়ে সালাম করা। উল্টো কাহিনিও আছে। অর্থাৎ জ্যেষ্ঠতার সুবাদে নিজের পায়েও বেশকিছু হাতের ছোঁয়া পাই। ভালোই লাগে। পুলকিত হই; কিন্তু এ সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে কাউকে কাউকে যখন বয়ান দিতে শুনি তখন ভীষণ খারাপ লাগে। এইসব লোক কথায় কথায় পবিত্র ধর্মকে টেনে আনে। সামাজিকতা-আন্তরিকতা বলতে যে আরও কিছু বিষয়-আশয় আছে, এই বকধার্মিকরা হয় জানে না অথবা জেনেও না জানার ভান করে।
প্রত্যেক দেশের-প্রত্যেক সমাজেরই নিজস্ব কিছু রীতিনীতি বা মূল্যবোধ থাকে। এসবের প্রাথমিক শিক্ষালয় পরিবার। অর্থাৎ বোধশক্তি জাগ্রত হওয়ার পর পারিবারিক পরিবেশেই প্রত্যেকটি মানুষ এসব রপ্ত করে। এরপর শিখে সমাজ থেকে। শিখতে হয় জীবনকে বিকশিত করার প্রয়োজনে। এই মূল্যবোধের অবমূল্যায়ন হলেই সমাজে অবক্ষয় নামে। সুতরাং বলতেই পারি, ঈদ সামাজিক মূল্যবোধকেও শাণিত করে।
এখনও মনে আছে, শৈশব-কৈশোরে ঈদগাহ থেকে ফিরেই দল বেঁধে বড়দের সালাম করতে ছুটতাম। পরিবারের আর বাড়ির বড়রা শুধু নন, প্রতিবেশীরাও সালাম পাওয়া থেকে বাদ পড়তেন না। বিনিময়ে মিলতো মজার মজার খাবার অর্থাৎ পিঠা-পুলি-সেমাই। এ ছাড়া পরদিন বা সময় করে দূরের গ্রামে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও মুরব্বিদের সালাম করতে যেতে হতো। সেখানকার মাটির চুলোয় গরম করা বাসি সন্দেশ, নকশা করা পিঠা (হাতেকাটা ও মুখপাকন), পাপড় ইত্যাদির আলাদা স্বাদ যেন এখনও মুখে লেগে আছে। নিজেও বানাতাম। বেশ পটুই ছিলাম। মা-খালারা তাই তাদের সঙ্গে পিঠা বানানোর কাজে ডেকে নিতেন।
হঠাৎ করে একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। বড়রা এটা বুঝেই হয়তো লোভ দেখাতেন, সূর্য উঠার আগে পর্যন্তপুকুর-নদী ভরা থাকে ‘জমজম’-এর পানিতে। এ পানিতে গোসল করলে সওয়াব বেশি হবে। তাই সওয়াবের স্বপ্নে শেষ রাতেই ঘুম ভেঙে যেতো।
আমার জন্ম আর শৈশব-কৈশোরের দিনযাপন মামার বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার নানাদিক দিয়ে অগ্রসর জগদল গ্রামে। ঈদ উদযাপনের শুরুটাও সেখানে। বাড়ির ছোটরা দল বেঁেধ বড় নানা (মায়ের বড় চাচা) জগদল ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম চেয়ারম্যান আব্দুল হকের সঙ্গে ঈদগায় যেতাম। এলাকার মধ্যে জগদলেই ছিল শুধু বিরাটাকারের পাকা ঈদগাহ। আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের লোক সেখানে নামাজ পড়তে আসতেন। প্রথম প্রথম আমরা অর্থাৎ ছোটরা বড়দের নামাজ পড়ার সময় ঈদগার লাগোয়া মাদ্রাসা ভবনের বারান্দায় বা সামনের মাঠে জড়ো হয়ে বন্ধুদের নিয়ে চুটিয়ে আড্ডা মারতাম।
এখনও চোখের সামনে ভাসে বড় নানাজির ঈদের জামাতে যাওয়ার প্রস্তুতির দৃশ্য। অত্যন্ত সুদর্শন চেহারা, দীর্ঘ-সবল দেহ আর মুখভর্তি সাদা দাড়ি। বছরে দুই ঈদ আর সিলেট-সুনামগঞ্জ আসা-যাওয়ার সময় ছাড়া বাকি সময় যতœ করে আলমারিতে তালাবদ্ধ করে রাখা শেরওয়ানি-পাঞ্জাবি-পায়জামা বের করে পড়ে অনেকক্ষণ ধরে গায়ে সুগন্ধি মাখতেন। এরপর সময় ঘনিয়ে এলেই তাগিদ লাগাতেন সবাইকে। জামাতে সামনের কাতারে তার জন্যে জায়গা খালি রাখা হতো। বর্ষায় নৌকায় করে ঈদগায় যেতাম।
ঈদের আগেও আরেকটা আনন্দ ছিল। সেই আনন্দ ছিল ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে। তবে ২৯ রমজানের দিন চাঁদ দেখার যেমনি তাগিদ থাকতো বেশি তেমনি থাকতো বেশি আনন্দ। কারণ ছিল দুটি। একটি হলো চাঁদ দেখা গেলে রোজা শেষ। আরেকটি হলো পরদিন ঈদ। তাই সন্ধ্য নামতেই দল বেঁধে আকাশে চাঁদ খুঁজতে শুরু করতাম। কেউ খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে, কেউবা ঘরের ছাদে উঠে আবার কেউ কেউ গাছে চড়ে চাঁদ মামার সন্ধান করতো। কার আগে কে দেখতে পারে এ নিয়ে রীতিমেতো প্রতিযোগিতা হতো। চাঁদ দেখা না গেলে মন কিছুটা খারপ যে হতো না, তা কিন্তু নয়।
পরদিন চাঁদ দেখার খুব একটা আকর্ষণ থাকত না। কারণ চাঁদে দেখা গেলেও যা না দেখা গেলেও তা অর্থাৎ পরদিন ঈদ হবেই। রোজা তো আর একত্রিশটা হবে না। তবু দেখার চেষ্টা করতাম। কেননা, আরবি পড়তে গিয়ে হুজুরদের কাছে শুনেছিলাম, ঈদের চাঁদ দেখার মধ্যে সওয়াব আছে। দেখার পর হুজুরের শেখানো দোয়াও পড়তাম। চাঁদ দেখা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হলে গ্রামের মুরব্বিরা বসে সিদ্ধান্ত নিতেন। এখন সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি। নিশ্চিত করে গণমাধ্যম। তাই আকাশে চাঁদ খুঁজে বেড়াতে হয় না।
ঈদে নতুন জামা-জুতোর কোনও প্রচলন গ্রামাঞ্চলে প্রায় ছিল না। তবে জামাগুলোর মধ্যে যেটি সুন্দর বা বেশি পছন্দের সেটি কয়েকদিন আগেই ধুয়ে ভাঁজ করে রাতে ঘুমানোর সময় বালিশের নিচে রাখতাম। কারণ এখনকার মতো ইস্ত্রির সুযোগ ছিল না।
এমনিতে সাধারণত সন্ধ্যায় হাত-মুখ ধোয়ার সময় পা ধুয়ে জুতো পায়ে দিতাম। এর আগে সারাদিন পা খালিই থাকত; কিন্তু ঈদের ছিল ব্যতিক্রম। সকালবেলা জুতো পড়েই ঈদগায় যেতাম। ফিরে আসা পর্যন্ত পায়ে থাকলেও এরপর ঘরের কোণে ঠাঁই পেতো।
এএফ/০১