সুমনকুমার দাশ
মে ১৪, ২০২১
০৮:০০ অপরাহ্ন
আপডেট : মে ১৪, ২০২১
০৮:০০ অপরাহ্ন
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটি ঘিরে শৈশবের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এখনও তাড়িত হই এ গান শোনে। যত শুনি, তত মুগ্ধ হই। একবার নয়, দুইবার নয়, বার বার শুনি। তবুও যেন তৃষ্ণা মেটে না। অমোঘ এ আকর্ষণ। একদিনের কথা মনে পড়ে, তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। শাহজাহান ছিল আমার সহপাঠী। বেদে সম্প্রদায়ের হওয়ায় শাহজাহানদের পরিবার থাকত নদীতে, নৌকায়। তার সঙ্গে আমার গলায়-গলায় ভাব। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষায় সে প্রথম হলে আমি দ্বিতীয়, কিংবা সে দ্বিতীয় হলে আমি প্রথম। কিন্তু এ নিয়ে কারও মধ্যে কখনওই প্রতিদ্ব›িদ্বতামূলক আচরণ ছিল না, ছিল না একজনকে টপকে অন্যজন উঁচুতে ওঠার মানসিকতাও। তবে, একদিন সে দৃশ্য বদলে যায়। তখন ছিল রমজান মাসের এক সন্ধ্যা। কদিন পরই ঈদ। নৌকায় বসে শাহজাহানের পরিবারের সঙ্গে ওই সন্ধ্যায় ইফতার করি। যখন বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিই, তখনই শাহজাহান গুনগুনিয়ে ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটি আওড়াল। কিন্তু দ্বিতীয় পঙ্ক্তি গাওয়ার সময় সে অনেকটাই হেরফের করে ফেলে। আমি তখন শাহজাহানকে জানাই, পুরো গানটা আমার মুখস্ত।
শাহজাহান আর আমার কথা শোনে এগিয়ে আসেন মতি চাচা। তিনি শাহজাহানের বাবা। বললেন, ‘তাইলে দুইজনের মইধ্যে একটা প্রতিযোগিতা অই যাক! দেখি জিতে কেডা?’ চাচার এ আহŸানের পর শুরু হয় গানের প্রতিযোগিতা। চাচা পুরস্কারও ঘোষণা করলেন। যে জিতবে, সে পাবে পাঁচ টাকার চকলেট। পাঠ্যবইয়ের বাইরে এই প্রথম কোনও প্রতিযোগিতায় আমার অংশ নেওয়া। মুখোমুখি শাহজাহান আর আমি! গান গাইতে পারি না। তাই অনেকটা আবৃত্তির ঢঙেই আমরা নিজেদের মতো করে গানটি পাঠ করলাম। গাইতে (কিংবা পাঠ করতে) গিয়ে শাহজাহান বার বার পদ ভুলে যাচ্ছিল। একটু পর-পরই কেবল সে সুরে সুরে গাইছিল ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। শাহজাহানের ভুলচুক গাওয়ার পর এলো আমার পালা। আমি চোখ বন্ধ করে গরগর করে এক নিশ্বাসে পাঠ করে ফেললাম পুরো গানটি। মুহুর্তেই আমাকে কোলে তুলে নেন মতি চাচা। বলেন, ‘বাবা, তুমি এইডা শিখলা কার কাছ থাকি?’
মতি চাচা চোখ-মুখে হাত বুলিয়ে আমাকে আদর করছিলেন। এগিয়ে আসেন শাহজাহানের মা, আমেনা চাচিও। তখন দাড়াইন নদের আকাশ আর চরাচর জুড়ে নেমে আসতে শুরু করেছে রাজ্যের অন্ধকার। সে অন্ধকারেও আমার চোখে পড়ল, নৌকার গলুইয়ের পাশে পাটাতনে দাঁড়িয়ে থাকা সদ্য পরাজিত-একাকি শাহজাহানের চোখ পানিতে চিকচিক করছে। আমার অন্তরটা কেঁপে উঠল! তবে কী শাহজাহানকে প্রতিযোগিতায় হারানোটা আমার ভুল হয়ে গেল? আমারও চোখ দিয়ে গরগর করে পানি ঝরে। মতি চাচা আমাকে কোলে নিয়ে নৌকা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত আমাদের বাসার পাশে এলেন। বাসার পাশের একটি দোকান থেকে কিনে দিলেন পাঁচ টাকা দিয়ে ২০টি চকলেট। প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জেতা আমার জীবনের প্রথম কোনও পুরস্কার! মুঠো ভরতি চকলেট হাতে নিয়ে আমি ভাবি শাহজাহানের কথা। ওই রাতে আর পড়াশোনায় মনোযোগ বসাতে পারিনি। বার বার চোখে ভাসে পরাজিত ও বিধ্বস্ত শাহজাহানের মুখ, যে কি না আমার প্রিয় সহপাঠী।
সে ঘটনার পর কেটে গেছে আড়াই দশকেরও বেশি সময়। এখনও যখন প্রতি ঈদুল ফিতরের আগে টিভিতে বেজে উঠে ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’, তখনই মনে পড়ে শাহজাহানের মুখ। মনে পড়ে মতি চাচা আর আমেনা চাচিকে। চার সন্তানের পিতা শাহজাহান এখন আমাদের উপজেলা সদরের বাজারে পুরোনো ছাতা সারাই করে, তালার চাবি বানিয়ে দেয়। পঞ্চান্নর্ধ্বো আমেনা চাচি আর এখন গ্রামে গ্রামে ফেরি করে ফিতা-চুড়ি-টিপ বিক্রি করেন না। মতি চাচাও নেই। পয়ষট্টি বছর বয়সে মারা গেছেন ২০১২ সালে। তবে আমি ভুলিনি তাঁদের কথা। কারণ, সেটাই ছিল আমার জীবনে প্রথম কোনও প্রতিযোগিতা। সে স্মৃতি মনে পড়লেই প্রথম পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতি ছাপিয়ে আমার কেবল মনে পড়ে, অন্ধকারে শাহজাহানের চোখে চিকচিক করা পানি। সেই অন্ধকারেও কত-না স্পষ্ট ছিল তার বিধ্বস্ত মুখ!
শৈশবের সে স্মৃতি-তাড়িত গানের প্রতি মুগ্ধতা এখনও একবিন্দু পরিমাণ কমেনি। সেই শৈশব-কৈশোর-যৌবনে রেডিও-টিভিতে চানরাতে বেজে উঠত ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। সত্যি যেন খুশি লাগত মনে! ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে ভিন্ন সম্প্রদায়ের হলেও কখনও আমার মনে একটিবারের জন্যও উঁকি দেয়নি, এ গান আমার নয়! জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯-২৯ আগস্ট ১৯৭৬) রচিত কার্হাবা তালের এ গানটি তো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে সেই একই রকম মুগ্ধতা ছড়িয়ে আসছে ১৯৩২ সালের পর থেকে। বাঙালির রোজার ঈদ আর এ গান যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, ঐতিহ্য তো বটেই।