ছোটবেলার ঈদ, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঈদ

সিলেট মিরর ডেস্ক


মে ১৫, ২০২১
১১:০৩ অপরাহ্ন


আপডেট : মে ১৫, ২০২১
১১:০৩ অপরাহ্ন



ছোটবেলার ঈদ, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঈদ

প্রতিবছরের ন্যায় আবারও এসেছে ঈদ-উল-ফিতর। মুসলমানদের সবচেযে বড় আনন্দ উৎসব। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর এসেছে খুশির এই উপলক্ষটি। ঘরে-ঘরে, জনে-জনে আনন্দ ও খুশির বার্তা বয়ে এনেছে এই ঈদ। দিনটি ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা ও ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলকে এক কাতারে শামিল করার চেতনায় উজ্জীবিত করে। কল্যাণের পথে ত্যাগ ও তিতীক্ষার মূলমন্ত্রে দীক্ষিত করে।

ঈদের শৈশব-কৈশোরের সঙ্গে এখনকার অনুভ‚তিতে অনেক পার্থক্য। হয়তো স্মৃতি রোমন্থন করা হয় না। 

বর্তমানে ঈদ উদযাপনের আনুষ্ঠানিকতায় বেশ পরিবর্তন এসেছে। বিষয়টা আন্তরিকতার চেয়ে আনুষ্ঠানিকতা আর সামাজিক মর্যাদার হয়ে গেছে। কিন্তু ঈদের প্রকৃত বার্তাটা ভিন্ন। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি ঈদ আসলে বিশেষ করে রোজার ঈদে হিন্দু-মুসলিম বলে কিছু ছিল না। সবাই মিলে এই উৎসবে মিলিত হতাম। পূজার সময়ও সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকত। উৎসব মানে ছিল সব মানুষের। এখন এই সম্প্রীতি নেই। হিংসা-বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে মৌলবাদীরা। গত কয়েকদিন ধরেই হেফাজতে ইসলাম ও দেশবিরোধীদের উল্লম্ফন দেখে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছি। আমরা আমাদের সংস্কৃতি-ঐতিহ্য থেকে যেন ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। মনে আর আগের মতো ‘ঈদ আনন্দ’ উপভোগ করার তাড়া পাই না।

আমরা যখন ছোট ছিলাম আমাদের ঈদের আনন্দ সাত-আটদিন আগেই শুরু হয়ে যেত। এখনকার মতো মায়েরা শপিং করতেন না। বাবা আমাদের পোশাক কিনে আনতেন। কোরবানির ঈদেও একই রকম ছিল। বাবা পোশাক কিনে দিলেও আকর্ষণ ছিল কোরবানির পশুর দিকেই বেশি। ষাটের দশকের কথা, এত এত মার্কেট-শপিংমল ছিল না। জিন্দাবাজারে পারভিন ক্লথ স্টোর নামের একটি রেডিমেইড দোকান ছিল। এটি শার্টি-প্যান্টিংয়ের। আর লালদিঘিরপাড়ে একটি এবং মহাজনপট্টিতে একটি রেডিমেইড দোকান ছিল। তখনও হাসান মার্কেট হয়নি, এখানে কয়েকটি ছোট ছোট দোকান ছিল। এত নাগরিক ব্যস্ততাও তখন ছিল না। রাস্তা ঘাট ফাঁকা ছিল। ঈদে দিনের বড় আনন্দ ছিল তীব্র শীতের মধ্যেও সকালে প্রতিযোগিতা করে সবার আগে গোসল করা। এর পর ঈদগাহে গিয়ে নামাজ পড়া। অনেকই রিকশা করে যেতেন। আমরা বাবার হাত ধরে সব ভাই-প্রতিবেশী মিলে হেঁটে হেঁটে ঈদগাহে গিয়ে নামাজ পড়তাম। এসব স্মৃতি এখনও তাড়িয়ে বেড়ায়। এখন এসব দেখা যায় না। খোলা আকাশের নিচে তখন ঈদের জামাতের প্রচলন ছিল। তখন মসজিদের ভেতরে ঈদের জামাত হতো না। 

সিলেট শহরে তখন শাহী ঈদগাহে আর হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার মসজিদ প্রাঙ্গণে ঈদের জামাত হতো। আমরা ঈদগহে গিয়ে নামাজ পড়তাম। এই যে পাড়া-প্রতিবেশী সবাই মিলে নামাজ পড়ার আনন্দ এসব স্মৃতি আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। এরপর ছিল সবার বাসায় যাওয়া। আমরা বন্ধুবান্ধব মিলে বাসায় বাসায় ঘুরে বেড়াতাম। এটাই ছিল সেই সময়ের ঈদের বা যে কোনও উৎসবের সংস্কৃতি। সবাই মিলে সকল উৎসবের আনন্দ এভাবেই আমরা ভাগাভাগি করে নিতাম। কোরবানি ঈদের আগেও একই অবস্থা। শুরু হয়ে যেত এবার কী কোরবানি দেওয়া হবে সেই হিসেব করা। গরু দিবেন নাকি ছাগল কোরবানি দিবেন। গরু কোরবানি দিলেও একটি ছাগল দেওয়ার বায়না ধরতাম।

ঈদের দিনে আমরা প্রচুর সিনেমা দেখতাম। সিলেটে তখন তিনটি সিনেমা হল ছিল। দিলশাদ, লালকুঠি ও অবকাশ। তিনটি সিনেমা হলেই তখন ম্যাটিনি শো চলত। আমরা অগ্রিম টিকিট কিনে রাখতাম। ঈদের দিন এই তিনটি সিনেমা হলে গিয়েই আমরা সিনেমা দেখতাম। তখন এসব সিনেমা হলে ভারতীয় বাংলা সিনেমা, বাংলাদেশের সিনেমা এবং উর্দু ভাষার সিনেমা দেখানো হতো। উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা দেখার জন্য আমরা মুখিয়ে থাকতাম। বন্ধু-বান্ধবরা মিলে ঈদের কয়েকদিন নতুন সিনেমা দেখার প্রতিযোগিতা ছিল আমাদের মাঝে। 

আমাদের বয়স তখন কত, ১২ কিংবা ১৩ বছর হবে। তখন পরিবারের সবাইকে নিয়েও আমরা সিনেমা দেখতে যেতাম। মা-বাবা-ভাই-বোন সবাই মিলে সিনেমাহলে যেতেন। এখন তো সিনেমা হলই নেই। যা কয়টা আছে, সেখানে এখন যেসব সিনেমা দেখানো হয়, তা পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখা সম্ভব নয়। এর মধ্যে সিনেমা হলে সবাইকে নিয়ে যাওয়ার মতো পরিবেশও নেই। 

মুক্তিযুদ্ধের মাঠে ঈদ কোনদিন ছিল, সেটা তো আমরা বলতেই পারব না। সে সময় হয়তো আমাদের কেউ কেউ ছিলেন বাঙ্কারে আবার কেউ কেউ ছিলেন যুদ্ধের ময়দানে। প্রথম যখন ঈদ-উল-ফিতর গেল, সেটা আমরা কেউই জানতে পারিনি। আমাদের একজন বললেন, গতকাল তো ঈদ ছিল। একদিন পরে জেনেছি ঈদ। ঈদের দিনও আমরা রোজা ছিলাম। যুদ্ধের পুরো সময়টাই আমাদের রোজার মতো কেটেছে। একদিন খেলে আর তিন-চারদিনের মধ্যে খাবার নেই। এভাবে দুই-তিন দিন একনাগাড়ে না খেয়ে থাকতে হয়েছে। 

ঈদের দুই দিন পর আমার বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক চৌধুরীরর সঙ্গে দেখা হলো। তাকে খাবার কিছু আছে কি না, জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল, কে যেন তাকে দুই দিন আগে কিছু খিচুড়ি দিয়ে গেছে। বললাম বের করে দে, দেখি গন্ধ-টন্ধ না হলে খাই। এর আগের তিন দিন আমি না খেয়ে আছি। তার দেওয়া সেই খিচুড়ি খেয়ে পানি খেয়ে নিলাম। যুদ্ধের ময়দানে আমাদের দুই ঈদই এভাবে কেটেছে। ওই সময়ে অনেকেই হয়তো ঈদের খবর জেনেছেন। আনন্দ উপভোগ করেছেন। কিন্তু টেরই পাইনি যুদ্ধের সময় কিভাবে দুইটি ঈদ চলে গেছে।

গত বছর দুটি ঈদ করোনার কারণে একেবারেই দুঃখজনকভাবে কাটল। কোনওভাবেই আনন্দ করতে পারেনি। আসলে আমাদের আনন্দের জায়গাগুলো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। এখন তো আর সেরকমভাবে উদযাপন করতে পারব না। এখন মনে হয় ঈদ আসলে বাচ্চাদের। এই যে আমার নাতি আছে। তাদের আনন্দ দেখলেই মনে হয়, এই তো ছেলেবেলার ঈদের আনন্দ ধরা দিচ্ছে। বাচ্চারা আনন্দে থাকুক। উৎসবের আনন্দে।