ওরা আর স্কুলে ফিরবে না!

উজ্জ্বল ধর, ওসমানীনগর


সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২১
০৬:৩৯ অপরাহ্ন


আপডেট : সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২১
০৬:৪১ অপরাহ্ন



ওরা আর স্কুলে ফিরবে না!

দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর খুলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। উৎসবের আমেজ বইছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। কিন্তু মহামারি করোনা অনেক শিক্ষার্থীকে অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। পারিবারিক অভাব-অনটনে অনেকে বাধ্য হয়ে পড়াশোনা বাদ দিয়ে উপার্জনের পথে নেমেছে। অনেকের হয়েছে বাল্যবিয়ে। 

ওসমানীনগর উপজেলায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ২ শতাধিক সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোতে অর্ধলক্ষাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। কিন্তু করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় নিম্নবিত্ত পরিবারের অনেক শিক্ষার্থী পরিবারের রোজগারের অবলম্বন হয়ে উঠেছে। অনেকে লেখাপড়া ছেড়ে কাজ করছে বাবার কৃষিজমিতে। করোনাকালে ঝরে পড়া এসব শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। উপজেলা শিক্ষা বিভাগ বলছে- এতদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এ ব্যাপারে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।

বেসরকারি সংগঠন ওসমানীনগর ছাত্র কল্য্যণ পরিষদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে প্রতিবছর প্রাথমিক শিক্ষা শেষের আগে প্রায় ১৭ শতাংশ ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষের আগে প্রায় ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। করোনা মহামারিতে ঝরে পড়াদের তালিকা আরও দীর্ঘ। করোনা সংকটে ওসমানীনগরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে অতিরিক্ত আরও ১০ ভাগ শিশুর শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটেছে। যাদের বিদ্যালয়ে ফেরানোটাই এখন চ্যালেঞ্জ।

সমীক্ষা বা তথ্যচিত্র যা-ই বলুক, করোনা সংকটে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর ওপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তা অস্বীকারের উপায় নেই। আর এ ঝড় থেকে পরিবারকে রক্ষায় শিক্ষার্থীদের কেউ হয়েছে উপার্জনের খুঁটি, আবার কেউ সামান্য সচ্ছলতার খোঁজে অল্প বয়সেই হাত সাজিয়েছে মেহেদীর রঙে।

সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত রওশন। করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কলোনির ছেলেদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে থাকত সারাদিন। রিকশাচালক বাবা আব্দুল আহাদ অনেকটা বিরক্ত হয়েই ছেলেকে গোয়ালাবাজারের একটি চায়ের দোকানে কাজে দিয়েছেন। মাস শেষে বেতন দেড় হাজার টাকা। রওশনের কাছেও চাকরিটা পড়াশোনার চেয়ে ভালো!

আব্দুল আহাদ বলেন, সে (রওশন) আর পড়বে না বলার পর আমিও চাপাচাপি করিনি। গরিবের ছেলে পড়াশোনা করে বেশি দূর যেতে পারবে না। এর চেয়ে আগেভাগে রোজগারে লেগে যাওয়াই ভালো। এতে টাকার প্রতি মায়া বাড়ে।

মঙ্গলপুরের নওরিন বেগম (ছদ্মনাম) ক্লাস নাইনে পড়ত। কাঠমিস্ত্রি বাবা শিবলু মিয়া মেয়েকে পড়াশোনার জন্য সবসময় সমর্থন যোগাতেন। কিন্তু করোনাকালে পরিবারের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। অভাবে দিশেহারা বাবা মেয়েকে পাঠিয়ে দেন তার খালার বাড়িতে। সেখানে গত জানুয়রিতে নওরিনের অমতে জোর করে তাকে বিয়ে দেওয়া হয় খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে। নওরিনের বইগুলো এখনও টেবিলের উপরে সাজানো।

শিবলু মিয়া বলেন, শখ ছিল নওরিনকে এসএসসি পাশ করাবো। কিন্তু করোনাকালে আমার আয় বন্ধ, ঘরে ৬টা উপোস মুখ। উপায় না পেয়ে নওরিন ও তার বোনকে তাদের খালার বাড়ি পাঠিয়েছিলাম। খালাতো ভাই নওরিনকে পছন্দ করে বসল। অনেকটা বাধ্য হয়েই বিয়ে দিলাম।

ছালিক (১৩) ও শাহীন (১১) দুই ভাই। করোনা সংকটে এই দুই ভাই পড়াশোনা বাদ দিয়ে উপার্জনে নেমেছে। কাগজ, প্লাস্টিক ইত্যাদি কুড়িয়ে বিক্রি করাই এখন তাদের পেশা। সকাল থেকে রাত অবধি খেটে পরিবারের আহার নিশ্চিত করাই লক্ষ্য তাদের। তাই স্কুল কবে খুলবে না খুলবে তা নিয়েও তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।

ছালিক জানায়, তার পিতা গত ১ বছর ধরে শয্যাশায়ী। পরিবারের আয়ের পথ না থাকায় তারা বাধ্য হয়েই কাজে নেমেছে। পড়াশোনার খোঁজ তারা রাখে না। 

গোয়ালাবাজার আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শামসুল হক বলেন, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই করোনাকালে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সংখ্যা বেড়েছে। অনেক ছাত্রকে এখন সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত টমটম চালাতে দেখা যায়। আর বাল্যবিয়ে তো আছেই। স্কুল খুলেছে। এখন শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে। 

ওসমানীনগর উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা শরিফ মো. নেয়ামত উল্যাহ জানান, করোনার সংক্রমণকালে ওসমানীনগরের প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঝরে পড়াদের কোনো তালিকা তার কাছে নেই। তবে তিনি চলতি বছরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০২২ সালের জন্য ২১ হাজার ২৮৫ সেট সরকারি বইয়ের চাহিদা উল্লেখ করেছেন।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা স্বপন কুমার চক্রবর্তী বলেন, দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় ঝরে পড়াদের তালিকা তৈরি করা হয়নি। বিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস চালু হয়েছে। এখন বিদ্যালয়ওয়ারি ঝরে পড়াদের তালিকা সংগ্রহ করে তাদের ক্লাসে ফেরাতে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।



ইউডি/আরআর-০২