শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং ‘মহব্বত আলীর একদিন’

আহমেদ নূর


জানুয়ারি ১৯, ২০২২
০৪:০৪ পূর্বাহ্ন


আপডেট : জানুয়ারি ২০, ২০২২
০৫:৪৯ অপরাহ্ন



শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং ‘মহব্বত আলীর একদিন’
সংবাদ বিশ্লেষণ

‘ভোর রাতে মহব্বত আলীর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গিয়ে তার মুখটা ধুতে লাগলেন। তার মনে হতে লাগল খ্যাপা ধরনের একটা মেয়ের থুতু এখনো তার মুখে লেগে আছে। তিনি যতই সেটা ধোয়ার চেষ্টা করছেন কিছুতেই পরিষ্কার করতে পারছেন না। কিছুতেই না।’

এটা একটি উপন্যাসের চরিত্রের বর্ণনা। এ বিষয়ে পরে আসছি। তার আগে কিছু কথা বলা দরকার। অবশ্যই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি নিয়ে। গতকাল একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলাম। ভেবেছিলাম এ নিয়ে আর কিছু লেখার প্রয়োজন পড়বে না। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। অন্তত অতীত অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। কিন্তু হলো কই? অনেক পাঠক-শুভাকাঙ্ক্ষী মুঠোফোনে কল করে তাগিদ দিয়েছেন বিষয়টি নিয়ে লেগে থাকতে।

পেশাগত কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাড়ি-নক্ষত্র আমার চেনা। ১৯৯১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। সেই থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত একজন সংবাদকর্মী হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড খুব কাছে থেকে দেখেছি। ভালো দিক দেখেছি, খারাপ দিক দেখেছি, নোংরামিও দেখেছি। শিক্ষকদের রাজনীতিও দেখেছি। শুধু কী তাই?শিক্ষার্থীদের বলির পাঠা হতেও দেখেছি।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শুরুর দিকে ছিলেন তারা এসব জানেন। অনেকেই এখন অবসরে গেছেন। অনেকেই এই পৃথিবীতে নেই। অংকের অধ্যাপক মিরাজউদ্দিন মণ্ডল কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন। অকৃত্রিম সিলেটি গৌরাঙ্গদা অনেক আগেই পাড়ি জমিয়েছেন অনন্তলোকে। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিয়ের জয়নাল আবেদীন, অধ্যাপক রেজা ই করিম খন্দকার, গৌরগোবিন্দ গোস্বামী, সাদেকুল আরেফিন, ক্যাথেরিনা কেয়া রোজারিও কেউ এখন নেই। কেউ অবসরে, কেউ ছেড়ে চলে গেছেন। খ্যাতিমান বিজ্ঞানী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাকের মতো নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকও এই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ায় তাদের সুবর্ণ সময় ব্যয় করেছেন। রেজিস্ট্রার বজলুল মুবিন চৌধুরী। তাদের ভোলা যায়?

অপ্রাসঙ্গিক হলেও কথাগুলো বলতে হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গত ৪ থেকে ৫ দিনের উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে। বিশ্বদ্যিালয়ের ইতিহাসে যা ঘটেনি, তা ঘটেছে গত চার দিনে। যা ঘটেছে তা ভাবতেও গা শিউরে উঠে। ১৯৯৯ সালে শাহজালাল বিশ্বদ্যিালয়ের ভবিষ্যত শীর্ষক একটি জাতীয় সেমিনার হয়েছিল ক্যাম্পাসে। দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদরা এতে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে একটা কথাই উচ্চারিত হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয় একদিন ‘সেন্টার অব অ্যাকসিলেন্স’ হিসেবে গড়ে উঠবে। কিন্তু এটাই কী ‘সেন্টার অব অ্যাকসিলেন্সের’ নমুনা?

ছাত্রীদের তিন দফা দাবি এখন এক দফায় রূপ নিয়েছে। আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে সব শিক্ষার্থী। তাঁদের একটাই দাবিউপাচার্যের পদত্যাগ। আজ ১২টা পর্যন্ত সময় বেধে দিয়েছে তাঁরা। না হলে আমরণ অনশনের ঘোষণাও দিয়েছে। এমন আমরণ কর্মসূচির ঘোষণা সর্বশেষ শুনেছিলাম ২০০০ সালে। নামকরণবিরোধী আন্দোলনের সময়। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের প্রচেষ্টায় তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ শিক্ষার্থীদের এমন কর্মসূচি থেকে নিবৃত্ত করেছিলেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীরা আবেগী। তাঁরা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু তাঁদের নিবৃত্ত করতে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এবার সেটা দেখতে পাচ্ছি না। এটাই ভয়ের বিষয়।

আমি বিশ্বাস করি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সিলেটে শুভবোধসম্পন্ন অনেকেই আছেন। তাঁরা বিষয়টি নিয়ে ভাববেন। পরিস্থিতি জটিল হওয়ার আগেই বিষয়টির নিষ্পত্তি করবেন। আমাদের সন্তানদের সার্বিক মঙ্গলার্থে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। আমরা সবাই জানি, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া ক্যাস্পাসে পুলিশ ঢুকতে পারে না। সেই পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকেছে। শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি ছুড়েছে। তাঁদেরকে রক্তাক্ত করেছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ না করে সেই পুলিশকেই ফুল দিয়েছে। বিষয়টার গভীরতা অনুধাবন করতে পারছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ? যদি পারতেন তাহলে গতকালই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কেন হয়নি? কারণ শিক্ষা আর ব্যবসা এক জিনিস নয়। বহু আগে জাতিসত্তার কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদা (বর্তমানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচলক) বলেছিলেন, ‘যে হাতে ভোজালি উঠে সে হাতে কবিতা উঠে না।’

আমাদের রাজনৈতিক পোষ্য প্রশাসকদের সে বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একজনই উপাচার্য দ্বিতীয়বারের মতো নিয়োগ পেয়েছিলেন। তিনি ড. মো. সালেহ উদ্দিন। কিন্তু চার মাসের মাথায় নিজে থেকেই পদত্যাগ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পেরেছিলেন বলেই হয়ত সম্ভব হয়েছিল। পাশাপাশি গভীর রাতে হল দখলের মতো উপাচার্যের অফিস দখলের ঘটনাও এই দেশে ঘটেছে। আমরা এসবের পুনরাবৃত্তি চাই না। আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন দায়িত্বশীল উপাচার্য চাই। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভূত পরিস্থিতির সম্মানজনক ও গ্রহণযোগ্য সমাধান হবেএ প্রত্যাশা করি।

এবার সেই শুরুতেই ফিরে আসি। যে উপন্যাসটির কথা বলেছিলাম সেটি খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা। উপন্যাসটির নাম ‘মহব্বত আলীর একদিন’। উপন্যাসের মূল চরিত্র একটি পাবলিক বিশ্বদ্যিালয়ের উপাচার্য। ড. জাফর ইকবাল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক ছিলেন। অনেকবার মৃত্যুর হুমকি পেয়েছিলেন। সর্বশেষ হামলার শিকারও হয়েছিলেন। বর্তমান প্রশাসন তখন কত প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাসের ফানুস উড়িয়েছিলেন তা সংবাদপত্রের পাতায় আছে। জাফর ইকবাল বহুদিন হলো এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গেছেন। কেউ জানে, কেউ জানে না। হামলার পর সুস্থ হয়ে যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে জাফর ইকবাল এসেছিলেন সেদিন শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান উপাচার্য কী বলেছিলেন, মনে আছে? বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল আছে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের `ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের চরিত্র মেহের আলীর উক্তির মতো, ‘সব ঝুট হ্যায়’!


লেখক : সম্পাদক, দৈনিক সিলেট মিরর। 


 লেখকের এ সংক্রান্ত অন্য লেখা পড়ুন-

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতির দায় কার?