ইউরোপের পক্ষে যুক্তির ন্যায্যতা আছে কি?

স্লাভো জিজেক, রাশিয়া, ইউক্রেন,


মার্চ ০৯, ২০২২
০২:১৩ অপরাহ্ন


আপডেট : মার্চ ০৯, ২০২২
০২:১৪ অপরাহ্ন



ইউরোপের পক্ষে যুক্তির ন্যায্যতা আছে কি?
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ

রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের পর স্লোভেন সরকার বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ না করে হাজার হাজার ইউক্রেনীয় শরণার্থীকে গ্রহণের জন্য তার প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করে। স্লোভেনিয়ার একজন নাগরিক হিসেবে বিষয়টি আমার জন্য সম্মানের আবার ভীষণ লজ্জারও।

কেননা মাত্র ছয় মাস আগে তালেবানদের কাছে আফগানিস্তান পতনের পর একই সরকার দেশটির শরণার্থীদের গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। যুক্তি দেখায় আফগানদের উচিত নিজ ভূখণ্ডে থাকা এবং লড়াই করা। এছাড়া কয়েক মাস আগে যখন হাজারো শরণার্থী, যাদের অধিকাংশই ইরাকের কুর্দি, পোল্যান্ড ও বেলারুশে প্রবেশের চেষ্টা করে, স্লোভেনিয়ার সরকার তখন দাবি করে বসে ইউরোপ আক্রমণের শিকার হয়েছে। শুধু দাবি করেই চুপ থাকেনি, সীমান্ত থেকে শরণার্থীদের সরিয়ে দিতে সামরিক সাহায্য পাঠানোর কথাও উল্লেখ করে। 

তার মানে পুুরো অঞ্চলে দুই প্রজাতির শরণার্থীর উদ্ভব হয়েছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি স্লোভেন সরকারের/ এক টুইটে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়। তিনি/ টুইট করেন, ইউক্রেন থেকে যে শরণার্থীরা আসছে, তারা আফগান শরণার্থীদের থেকে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিকভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। টুইটটি ঘিরে সমালোচনা তৈরি হলে চটজলদি তা মুছে ফেলা হয়। তবে ততক্ষণে উলঙ্গ সত্যটি ছড়িয়ে পড়ে যে ইউরোপকে অবশ্যই অ-ইউরোপীয়দের থেকে রক্ষা করতে হবে।

ভূরাজনৈতিক প্রভাবের জন্য চলমান বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে এমন দৃষ্টিভঙ্গি বয়ে বেড়ানোটা ইউরোপের জন্য ভয়াবহ বিপদের কারণ হতে পারে বৈকি। আমাদের মিডিয়া আর অভিজাতরা এ লড়াইকে পশ্চিমা ‘উদারনৈতিক’ বলয় বনাম রাশিয়ার ‘ইউরেশিয়ান’ বলয়ের মধ্যকার দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখে। অথচ তারা বিশ্বের অন্যান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের কথা রীতিমতো এড়িয়ে যাচ্ছে। যেমন লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, তারা কিন্তু খুব সূক্ষ্মভাবে আমাদের কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করছে।

এমনকি চীনও এখনো রাশিয়াকে পুরোপুরি সমর্থন দিতে প্রস্তুত নয়। তারা অবশ্য নিজস্ব ছক কষেই অগ্রসর হচ্ছে। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের একদিন আগে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনকে প্রদত্ত একটি বার্তায় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, ‘নতুন পরিস্থিতিতে’ চীন ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করতে প্রস্তুত তারা। ‘নতুন পরিস্থিতি’র দোহাই দিয়ে চীন তাইওয়ানকে ‘উদ্ধার’ করতে চাইবে, শঙ্কা এখানেই।

তাই আমাদের বর্তমান দুশ্চিন্তার কারণ চারপাশজুড়ে আমরা যে গোঁড়ামিগুলো দেখছি, যেমনটা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন, তা আর কথার কথা নেই। পুতিন যখন ইউক্রেনের সীমান্তে তার সৈন্যদের জড়ো করছিলেন তখন উদার বামপন্থীদের অনেকেই এটা মনে করে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন যে দুই পক্ষের কেউই পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের সামর্থ্য রাখে না, পুতিন স্রেফ তার ক্ষমতা দেখাতে চাইছেন।

এমনকি পুুতিন যখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সরকারকে ‘মাদকাসক্ত ও নব্য নািস’ বলে বর্ণনা করছিলেন তখন অনেকেই মনে করেছিলেন, তিনি হয়তো ক্রেমলিন সমর্থিত রাশিয়ান বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত দোনেত্স্ক ও লুশানস্ক দখল করবেন, আর বড়জোর পূর্ব ইউক্রেনের ডানবাস অঞ্চলের পুরোটুকুর দখল নিতে তত্পর হবেন।

এদিকে যারা নিজেদের বামপন্থী বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন (আমি তাদের বামপন্থী মনে করি না), তারা এখন পশ্চিমাদের কাঁধে দায় চাপিয়ে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তো পুতিনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ঠিকঠাক অনুমান করেছেন। তাদের যুক্তিগুলো সবার জানা; ন্যাটো ক্রমে রাশিয়া ঘিরে ফেলেছে, রাশিয়ার বাইরে ও সীমান্তের কাছে বিপ্লবের রঙিন স্বপ্ন দেখাচ্ছে, মদদ দিচ্ছে এবং গত শতাব্দীতে সংঘটিত পশ্চিমা আক্রমণের বিপরীতে দেশটির যুক্তিসংগত আশঙ্কাকে উপেক্ষা করেছে।

এ যুক্তিগুলোর অবশ্যই একটি সঠিক দিক রয়েছে। কিন্তু এগুলো উল্লেখের অর্থ অনেকটাই ভার্সাই চুক্তির চাপিয়ে দেয়া দাবিকে দোষারোপ করে হিটলারকে ন্যায্যতা প্রদানের সমতুল্য। সবচেয়ে বাজে দিক হচ্ছে বৈশ্বিক স্থিতির স্বার্থে বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রভাব বলয় তৈরির অধিকারকে স্বীকার করে নেয়া, অন্যরাও যা মেনে নিতে বাধ্য হবে। পুতিন মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মূলত শক্তি প্রদর্শনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যেমনটা তার বারবার করা দাবির মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়, ইউক্রেনে সামরিক হস্তক্ষেপ ব্যতীত অন্য কোনো বিকল্প নেই।

সত্যিই কি তাই? সমস্যা কি তবে ইউক্রেনীয় ফ্যাসিবাদ নিয়ে? প্রশ্নটি বরং পুতিনের রাশিয়াকে নিয়ে উঠতে পারে, যা সংগতও। পুতিনের বুদ্ধিবৃত্তিক গুরু হচ্ছেন ইভান ইলিন। তার রেখে যাওয়া কাজ ও গ্রন্থগুলো আবারো মুদ্রণের মাধ্যমে পার্টির সদস্য এবং সেনাবাহিনীতে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে।

১৯২০-এর দশকের গোড়ার দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর ইলিন ফ্যাসিবাদের একটি রুশ সংস্করণ প্রচার করতে শুরু করেন। সেখানে রাষ্ট্র একটি জৈব সম্প্রদায়, যা একজন সর্বোচ্চ শাসকের নেতৃত্বে পরিচালিত হবে কিংবা এ সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেবেন একজন পিতৃতুল্য রাজা। সেখানে স্বাধীনতা মানে নিজ নিজ অবস্থানে থাকা। তাই ইলিনকে (এবং পুতিনের জন্য) ভোট প্রদানের উদ্দেশ্য হলো পিতৃতুল্য নেতার প্রতি সম্মিলিত সমর্থন প্রকাশ। তাকে বেছে নেয়া বা তার বৈধতা যাচাই করা নয়। পুতিনের অন্যতম দরবারি-দার্শনিক ও পরামর্শক আলেকজান্ডার ডুগিন ঐতিহাসিক আপেক্ষিকতাবাদকে উত্তর আধুনিক অলংকরণে মুড়িয়ে নিবিড়ভাবে ইলিনের পদাঙ্কই অনুসরণ করেছেন; ‘কথিত সব সত্যই মূলত বিশ্বাসের বিষয়। তাই আমরা যা করি তা বিশ্বাস করি। আমরা যা বলি তা বিশ্বাস করি। এটাই সত্য নির্ধারণের একমাত্র উপায়। আমাদের নিজস্ব রুশীয় ন্যায্যতা রয়েছে, যা আপনাকে মেনে নিতে হবে। আমেরিকা যদি যুদ্ধ শুরু করতে না চায়, সেটা তাদের ব্যাপার। তবে এটাও মেনে নিতে হবে যে তাদের একক মোড়লগিরির দিন শেষ।’ এদিকে সিরিয়া ও ইউক্রেনের পরিস্থিতি নিয়ে রাশিয়া আমেরিকাকে বলছে যে ‘না, তুমি এখন আর বিশ্বমোড়ল নও।’ তাই প্রশ্ন হলো, বিশ্বকে কে শাসন করবে? কেবল যুদ্ধই তা নির্ধারণ করতে পারে।

কিন্তু সিরিয়া ও ইউক্রেনের জনগণের কী হবে? রাশিয়া কিংবা আমেরিকার মতো তারাও কি তাদের নিজস্ব সত্য বাছাই করতে পারে? নাকি তার শুধুই সম্ভাব্য বিশ্বমোড়লদের ক্ষমতা প্রদর্শনের লড়াই ক্ষেত্র হয়েই ধুঁকতে থাকবে?

প্রত্যেকের ‘জীবন দর্শন’-বিষয়ক নিজস্ব সত্য রয়েছে—এ ধারণা  যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ডানপন্থী পপুলিস্টদের কাছে পুতিনকে প্রিয় করে তুলেছে। ট্রাম্প তো রীতিমতো ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে ‘জিনিয়াস’ বলে প্রশংসা করছেন। এসব যৌথ অনুভূতি; পুতিন যখন ইউক্রেনে ‘ডিনাজিফিকেশন’ (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জার্মান ও অস্ট্রিয়ার সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতিসহ অন্যান্য বিষয়কে নািস মতাদর্শ মুক্ত করার উদ্যোগ) সম্পর্কে কথা বলেন, তখন আমাদের ফ্রান্সের ডানপন্থী নেতা মেরিন লে পেনের দল ন্যাশনাল র্যালি, ইতালির ডানপন্থী মাত্তেও সালভিনির লেগা নর্ড পার্টি এবং অন্যান্য নব্য ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের প্রতি তার সমর্থনের কথাও মনে রাখা উচিত।

‘রুশীয় সত্য’ মূলত পুতিনের সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে ন্যায্যতা দেয়ার পক্ষে একটি সুবিধাজনক পৌরাণিক কাহিনী বা মিথ। ইউরোপের পক্ষে যা মোকাবেলার শ্রেষ্ঠ উপায় উন্নয়নশীল ও উদীয়মান দেশগুলোর সঙ্গে সেতুবন্ধ তৈরি। এ দেশগুলোর মধ্যে অনেকের কাছেই পশ্চিমা উপনিবেশ ও শোষণের বিরুদ্ধে ন্যায্য অভিযোগের এক দীর্ঘ ফর্দ রয়েছে। তবে  ইউরোপকে রক্ষা করার জন্য শুধু তা যথেষ্ট নয়। আসল কাজটি হচ্ছে অন্য দেশগুলোকে এটা বোঝানো যে চীন ও রাশিয়ার তুলনায় পশ্চিমারা তাদের জন্য আরো ভালো কিছু করতে সক্ষম। আর তা অর্জনের একমাত্র উপায় হলো নব্য ঔপনিবেশিকবাদকে উপড়ে ফেলার মাধ্যমে নিজেদের পরিবর্তন করা। এমনকি যখন নব্য ঔপনিবেশিকবাদকে মানবিক সহায়তা নাম দিয়ে বিক্রি করা হয়, তারও ইতি টানা। 

আমরা কি এটা প্রমাণ করতে প্রস্তুত যে ইউরোপকে রক্ষা করার মধ্য দিয়ে আমরা বিশ্বের সর্বত্র স্বাধীনতার পক্ষে লড়ছি? যদিও সব ধরনের শরণার্থীর সঙ্গে সমান আচরণের বিপরীতে অ-ইউরোপীয়দের লজ্জাজনক প্রত্যাখ্যান কিন্তু আমাদের হয়ে বিশ্বকে একটি ভিন্ন বার্তা পাঠায়।


[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

স্লাভো জিজেক: ইউরোপিয়ান গ্র্যাজুয়েট স্কুলের দর্শনের অধ্যাপক, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্কবেক ইনস্টিটিউট ফর দ্য হিউম্যানিটিজের আন্তর্জাতিক পরিচালক

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

সৌজন্যে : বণিক বার্তা


এএফ/০৩