নদী খননই হাওরের রক্ষাকবচ

বিশ্বজিত রায়, হাওর থেকে ফিরে


মে ১১, ২০২২
০৭:১২ অপরাহ্ন


আপডেট : মে ১১, ২০২২
০৭:১২ অপরাহ্ন



নদী খননই হাওরের রক্ষাকবচ
# তলদেশ ভরাটে অল্পতেই উপচে উঠে পানি, # বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে যায় একফসলি জমি

পানিতে ভরপুর বৌলাই নদী। হালি হাওরের ঘনিয়ার কাড়া বাঁধ ঘেঁষে এভাবে থৈথৈ করছে পানি। ছবিটি এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে তোলা।

‘জরুরি ভিত্তিতে গাঙগুলো খননের দরকার। খনন করলেই সবথাইক্যা উত্তম হইব। নদীডি ভরাট হইয়া গেছে। খনন হইলে তো নদীত পানি ধরব বেশি। তখন পানিডা উপর দিকে উঠব কম। হাওরও নিরাপদ থাকব। কৃষকও বাঁচব।’ 

জামালগঞ্জের বেহেলী ইউনিয়নের হালি হাওর পাড়ের হাওড়িয়া আলীপুর গ্রামের বড় কৃষক মো. আয়না মিয়া এ কথাগুলো বলেন। হাওরের ফসল রক্ষায় নদী, খাল ও বিল খননের দাবি ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে। জামালগঞ্জে হাওরবেষ্টিত যে কয়টা নদী আছে প্রায় সবগুলোর তলদেশ কমবেশি ভরাট হওয়ায় অল্পতেই ফুলেফেঁপে ওঠা পানি কৃষকের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ বছর এপ্রিলের শুরুতে পাহাড়ি ঢল নেমে হাওরবেষ্টিত সব নদী পানিতে টইটুম্বুর হয়ে হাওর তলানোর শঙ্কা দেখা দিলে নদী খননের মতো দীর্ঘদিনের চাপা পড়া বিষয়টি ফের সামনে চলে এসেছে। হাওর পাড়ের কৃষক থেকে শুরু করে হাওর আন্দোলনের নেতা, কৃষক সচেতন মানুষের পক্ষ থেকে অচিরেই হাওর এলাকার সব খাল-বিল ও নদী খননের জোর দাবি উঠছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সংশ্লিষ্টরাও নদী খননের ব্যাপারে একমত পোষণ করে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানিয়েছেন।

জানা যায়, জামালগঞ্জে পাগনা, মিনিপাগনা, হালি, শনি (একাংশ), মহালিয়া, জুয়ালভাঙ্গাসহ (ছনুয়া-ডাকুয়া) ছোট-বড় ৬টি হাওর রয়েছে। হাওরগুলো সুরমা, রক্তি, বৌলাই ও পিয়াইন দ্বারা বেষ্টিত। উপজেলার বৃহৎ পাগনা হাওরের পশ্চিমে সুরমা ও দক্ষিণ দিকে পিয়াইন নদী বয়ে গেছে। দ্বিতীয় বৃহত্তম হালি হাওরের দক্ষিণে সুরমা ও উত্তর-পশ্চিমে বৌলাই নদী প্রবাহিত হয়েছে। বৌলাই তাহিরপুরের জাদুকাটা থেকে শুরু হয়ে ফতেপুর অংশে রক্তি ও বৌলাই নামে দুই দিকে মোড় নিয়েছে। এর মধ্যে বৌলাই জামালগঞ্জের বেহেলী ও তাহিরপুরের দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে দুই তীরের হালি, শনি ও মহালিয়া ছুঁয়ে ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইড় ও জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের ইনচানপুর হয়ে সুরমা নদীতে গিয়ে পড়েছে। এ নদীর প্রায় পুরো অংশজুড়েই চর জেগেছে। বিশেষ করে বেহেলী থেকে পৈন্ডুব বাজার পর্যন্ত মাত্রাতিরিক্ত চর জাগায় শুষ্ক মৌসুমে এই অংশে মারাত্বক নৌজটের সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে রক্তি নিয়ামতপুর গ্রাম ও জুয়ালভাঙ্গা হাওর ঘেঁষে ফাজিলপুর-দুর্লভপুর হয়ে সুরমায় মিলিত হয়েছে। এ নদীটি সম্প্রতি খনন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পাউবো।

এদিকে, পাগনা হাওরকে ঘিরে ধরা পিয়াইন জামালগঞ্জের ভীমখালী ইউনিয়নের কলকতখাঁ, হুগলি, সন্তোষপুর এবং দিরাই উপজেলার বাংলা বাজার, ভাটিপাড়া ও নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি হয়ে জামালগঞ্জের ফেনারবাঁক ইউনিয়নের আমানীপুর-আলীপুর মাঝ দিয়ে সুরমায় পতিত হয়েছে। অন্যদিকে, জামালগঞ্জ অংশের নোয়াগাঁও থেকে সাচ্না বাজার, গজারিয়া হয়ে আমানীপুর-আলীপুর পর্যন্ত পাগনা হাওরকে ঘিরে ধরেছে সুরমা। পাগনা হাওরবেষ্টিত সুরমা ও পিয়াইন এবং হালি তীরবর্তী বৌলাই নদী দীর্ঘদিন ধরে খনন না হওয়ায় তলদেশে চর জেগে পানি প্রবাহে মারাত্বক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই পানি বাড়ার সাথে সাথে নাব্যতা সঙ্কটে পড়া নদীগুলো দিন দিন পানি ধরে রাখার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। যে কারণে মারাত্বক ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে একফসলী হাওর। উপচেপড়া নদী নিমিষেই ভেঙ্গে দিচ্ছে ফসল রক্ষা বাঁধ নয়তো আফরে হাওর তলিয়ে কৃষককে সর্বস্বান্ত করছে। এমন পরিস্থিতিতে হাওর পাড়ের মানুষসহ কৃষকনেতারা দ্রæত নদী-খালসহ হাওরের অভ্যন্তরে বিল-ডোবা ও ছোটখাটো শাখা নদী খননের দাবি জানিয়েছেন।

বেহেলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. নূর হোসেন জানিয়েছেন, আগাম বন্যায় হাওর তলিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ পলি জমে নদী ভরাটের বিষয়টি। যেমন বেহেলী বাজারের খেয়াঘাট, বেহেলী উচ্চ বিদ্যালয় ও বাগানী গ্রামের মধ্যবর্তী অংশ, বদরপুর, পৈন্ডুব বাজারসহ বৌলাই নদীর বেশকিছু জায়গায় চর জেগেছে। শুষ্ক মৌসুমে দেখলে বোঝা যায় নদী কতটা ভরেছে। এ অবস্থায় নদী খননই হাওরের রক্ষাকবচ।

জামালগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, হাওর রক্ষা করতে হলে নদী খনন অবশ্যই দরকার। হালি হাওরের উলুকান্দি থেকে মাহমুদপুর-পৈন্ডুব আর রাঙ্গিয়া থেকে বেহেলী পর্যন্ত খনন করতে হবে। তাহলে নদীতে পানি বাড়লেও পানি সরবে তাড়াতাড়ি। হাওররক্ষা বাঁধে চাপ পড়বে কম।

বেহেলী ইউপি চেয়ারম্যান সুব্রত সামন্ত সরকার বলেন, হাওর বাঁচাতে হলে নদী খনন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদীগুলো নাব্যতা হারিয়েছে বলেই আজকের এই অবস্থা, হাওরের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে প্রস্তাব করা হয়েছে এবং পাউবো আমাদেরকে আশ্বাস দিয়েছে। যদি তা বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে হাওরবাসীকে আর কষ্টের  ফসল হারাতে হবে না।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, নদী খননের ব্যাপারটিতে আমাদের অলরেডি কাগজপত্র দাখিল করা ছিল। কিন্তু সরকারের একটা সার্কুলার আছে যে, ১০০ কোটি টাকার বেশি বাজেটের প্রজেক্ট হলে আবার স্টাডি করতে হবে। আমাদের মন্ত্রী মহোদয়ও ভিজিট করে গেছেন। তাঁরা যেন দ্রæতসময়ে এডিপিপি পাস করে দেন, সেই লক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বিএ-০১