থমথমে ইডেন কলেজ, ক্যাম্পাস ছাড়া রিভা-রাজিয়া

সিলেট মিরর ডেস্ক


সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২২
০৩:২৩ পূর্বাহ্ন


আপডেট : সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২২
০৩:২৩ পূর্বাহ্ন



থমথমে ইডেন কলেজ, ক্যাম্পাস ছাড়া রিভা-রাজিয়া
দিনভর দু'পক্ষে সংঘর্ষে আহত অন্তত ১০

ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের ঘরোয়া বিবাদ শেষ পর্যন্ত গড়াল তুমুল হাঙ্গামায়। রবিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সংগঠনটির সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানার বিরোধী পক্ষটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ওই দুই নেত্রীকে ক্যাম্পাসে 'অবাঞ্ছিত' ঘোষণা করে তাঁদের বহিস্কারের দাবি তোলে। পরে বিকেলে কলেজের বকুলতলায় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করতে চাইলে উত্তেজনা দেখা দেয়। একপর্যায়ে বেধে যায় সংঘর্ষ। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয় চেয়ার ছোড়াছুড়ি, ধাওয়াধাওয়ি ও চুল টানাটানি। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন।

সংঘর্ষের সময় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেন বিদ্রোহীরা। রিভা-রাজিয়াসহ আহত চার নেত্রীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) নেওয়া হয়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল গভীর রাতে ইডেন মহিলা কলেজ শাখার সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সংগঠনের সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এ ব্যাপারে পুলিশের রমনা বিভাগের ডিসি মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ইডেন কলেজের সামনের সড়ক রমনা বিভাগের মধ্যে পড়েছে। ঘটনার পর থেকে সেখানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আর কলেজের ভেতরের অংশ পুলিশের লালবাগ বিভাগে পড়েছে। যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে পুলিশ প্রস্তুত রয়েছে।

জানা যায়, সভাপতি রিভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া কলেজের হলগুলোতে সিট-বাণিজ্য করেন- এমন অভিযোগ তুলে সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেন সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌসী। এর কয়েক দিন আগে তাঁর পিত্তথলিতে পাথর ধরা পড়ে। এ কারণে তিনি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে বসেই তিনি সেই সাক্ষাৎকার দেন। এরপর আগামী ১৮ অক্টোবর তাঁর অস্ত্রোপচারের তারিখ দেওয়া হলে গত শনিবার হাসপাতাল থেকে তিনি হলে ফেরেন। হলে আসার পর রাত ১১টার দিকে কলেজ ছাত্রলীগের সহসভাপতি রোকসানা আক্তার, আয়েশা ইসলাম মীম, কামরুন নাহার জ্যোতি, ঋতু আক্তার, শিরীন আক্তার, সাংগঠনিক সম্পাদক আনিকা তাবাছ্‌ছুম স্বর্ণাসহ বেশ কয়েকজন জান্নাতের কক্ষে যান। তাঁরা সেখানে গিয়ে গণমাধ্যমে কেন কথা বলেছেন- এ বিষয়ে জান্নাতের কাছে জানতে চান। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে জান্নাতকে কলেজের পুকুরপাড়ে ডেকে নিয়ে মারধর করা হয়। এ সময় জান্নাতের অশ্নীল ভিডিও ধারণ করে তাঁর মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়।

মারধরের সময় জান্নাত এক গণমাধ্যমকর্মীকে ফোন দেন। সেই ফোনকলের অডিও রেকর্ড কাছে সংরক্ষিত আছে। তিন মিনিটের ওই অডিওতে জান্নাতকে বলতে শোনা যায়, 'মিডিয়ার সামনে কথা বলছি দেখে এখন ইডেন কলেজের সবাই আমার পেছনে লাগছে। এই যে আমাকে এখন রোকসানা ডাক দিল। মীম ইসলাম আমাকে ধরছে। সবাই আমাকে হাত ধরাধরি শুরু করে দিছে।'

এর আগে এ ঘটনায় ওই রাতেই রিভা-রাজিয়া এবং জান্নাতের অনুসারীরা ক্যাম্পাসে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নেন। এ সময় সাংবাদিকরা সেখানে গেলে রিভা-রাজিয়ার অনুসারীরা তাঁদের সঙ্গে অসদাচরণ করেন। এ সময় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা হলের সুপার নাজমুন নাহারসহ বেশ কয়েকজন সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

জান্নাতের অনুসারীরা তখন শিক্ষকদের কাছে তাঁদের নেত্রীর খোঁজ জানতে চাইলে তাঁরা জানান, জান্নাত তাঁদের কাছে আছে। এ পর্যায়ে জান্নাতকে ক্যাম্পাসের বকুলতলায় নিয়ে আসা হয়। এ সময় তিনি কয়েক দফা বমি করেন। রাত আড়াইটা পর্যন্ত সাংবাদিকরা ক্যাম্পাসে থাকাকালে দু'পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ করে।

গতকাল সকালে দু'পক্ষ আবারও ক্যাম্পাসে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নেয়। দুপুরের দিকে বিদ্রোহী নেত্রীরা সংবাদ সম্মেলন করেন। রিভা-রাজিয়ার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেওয়া হলে অন্তত ২৫ নেত্রী পদত্যাগ করবেন বলে সংবাদ সম্মেলন থেকে জানান তাঁরা। একই সঙ্গে তাঁরা ক্যাম্পাসে রিভা ও রাজিয়াকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন।

এর পরপরই জান্নাত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় রিভা-রাজিয়ার বিচার করা না হলে আত্মহত্যা করবেন বলে হুমকি দেন তিনি।

বিকেলে রিভা ও রাজিয়া সংবাদ সম্মেলন করতে ক্যাম্পাসে আসেন। এ সময় সেখানে বিদ্রোহীরা উপস্থিত হলে বাগ্‌বিতণ্ডা শুরু হয়। সেখানে দু'পক্ষ পরস্পরবিরোধী স্লোগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হলে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। এতে দু'পক্ষে অন্তত ১০ জন আহত হন।

সংবাদ সম্মেলনে সভাপতি তামান্না জেসমিন বলেন, 'আমাদের কমিটির শুরু থেকেই কয়েকটা মানুষ অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। যারা প্রত্যাশিত পদ পায়নি, তারাই বিশৃঙ্খলা করে আসছে। আজ সংবাদ সম্মেলন করে আমাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ আনা হয়েছে। আমরা চাই, একটা সুষ্ঠু তদন্ত হোক।'

ইডেন কলেজের একাডেমিক পরিষদের সদস্য মো. জিয়াউল হক সাংবাদিকদের বলেন, 'আজ পরীক্ষা থাকায় অধ্যক্ষ কারও সঙ্গে কথা বলবেন না। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সর্বোচ্চ ফোরামে কথা বলেছি। পরে সাংবাদিকদের ডেকে একদিন কথা বলবেন।'

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, আগের ঘটনা নিয়ে আমাদের তদন্ত চলমান। ওই ঘটনায় যাঁরা তদন্ত করছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজনের ভাই মারা গেছেন। যে কারণে তদন্ত একটু দেরি হয়েছে। এর মধ্যে আবার এই ঘটনা ঘটল। আমরা লিখিতভাবে জানিয়ে দিচ্ছি, আগের ঘটনা এবং এ ঘটনায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। প্রতিবেদন পেয়ে যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, আমরা তা নেব।

২৫ নেত্রীর পদত্যাগের হুমকি: এর আগে রাজধানীর ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রিভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়ার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে তাঁদের দু'জনকে কলেজ ক্যাম্পাসে 'অবাঞ্ছিত' ঘোষণা করেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের ২৫ নেত্রী। শিগগির তামান্না ও রাজিয়ার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেওয়া হলে ছাত্রলীগের কমিটি থেকে গণপদত্যাগের হুমকি দেন তাঁরা।

আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের ৪৮ সদস্যের কমিটির সহসভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পর্যায়ের ২৫ নেত্রী উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান সাংগঠনিক সম্পাদক সামিয়া আক্তার ওরফে বৈশাখী। তিনি বলেন, শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানার উপস্থিতিতে তাঁদের অনুসারীরা হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ছাত্রীনিবাসের সামনে সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌসের ওপর অতর্কিতে হামলা চালান।

২৫ নেত্রীর পক্ষে আট দফা দাবি তুলে ধরেন ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মার্জানা আক্তার ঊর্মি। দাবিগুলো হলো- ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতিতে সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌসের ওপর অতর্কিতে হামলার ঘটনায় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া; সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিয়ত হেনস্তার সুষ্ঠু বিচার; ক্যাম্পাসের যে কোনো সিসিটিভি ফুটেজ লুকানোর চেষ্টা বন্ধ করা; 'মাতৃতুল্য অভিভাবক' ইডেন কলেজের অধ্যক্ষকে (সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য) নিয়ে অপমানজনক বক্তব্য দেওয়া, একচেটিয়া রাজনীতি ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা; প্রতিটি ছাত্রী যেন নিরাপদে থাকতে পারেন, সে ব্যবস্থা করা; (তামান্না-রাজিয়ার অনুসারীদের) গণহারে শতাধিক কক্ষ দখলের হিসাব দেওয়া এবং জান্নাতুল ফেরদৌসের যেসব অশ্নীল ছবি তোলা হয়েছে, সব নেতার সামনে সব জায়গা থেকে তা ডিলিট করা (মুছে দেওয়া) ও ছিনিয়ে নেওয়া সব জিনিসপত্র তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া।

নিশ্চুপ প্রশাসন: এদিকে, এ ঘটনায় কলেজ প্রশাসন ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। জান্নাতকে মারধরের ঘটনায় প্রশাসনের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে দুপুরে সাংবাদিকরা তাঁর কার্যালয়ে যেতে চাইলে সেখানকার ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় কলেজ অধ্যক্ষের হয়ে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল আসে।

প্রতিনিধি দলের সদস্য ও ইডেন কলেজের একাডেমিক কমিটির সদস্য অধ্যাপক জিয়াউল হক সাংবাদিকদের জানান, তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত করতে যত দিন লাগে, তত দিন ধরেই চলবে। এর বেশি তিনি আর কিছু বলেননি।

অন্যদিকে, এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সংঘর্ষের বিষয়ে কলেজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বক্তব্য আসেনি। অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্যকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি।

ছাত্রলীগের তদন্ত কমিটি গঠন, কমিটি থেকে নাম প্রত্যাহার করলেন নিশি :ইডেন কলেজের ঘটনা তদন্তে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি তিলোত্তমা শিকদার ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বেনজির হোসেন নিশিকে নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় দপ্তর সেলে জমা দিতে বলা হয়েছে। রোববার সকালে ছাত্রলীগের সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় এবং সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

তবে এই তদন্ত কমিটির সদস্যপদ থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন নিশি। রোববার বিকেলে নিশি সমকালকে বলেন, তদন্ত কমিটির বিষয়ে কলেজ ছাত্রলীগের একজন প্রশ্ন তুললেও আমি সেই কমিটিতে থাকতাম না। সেখানে অনেকেই এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আমি এই কমিটিতে থাকতে চাই না। এ বিষয়ে আমি কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে জানিয়েছি।

তবে এ বিষয়ে জানতে আরেক সদস্য তিলোত্তমা শিকদারকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। এদিকে, এই তদন্ত কমিটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন বিদ্রোহীরা।


এএফ/০3