ঘরের মাঠই মরণফাঁদ

খেলা ডেস্ক


অক্টোবর ২১, ২০২৩
০১:১৬ অপরাহ্ন


আপডেট : অক্টোবর ২১, ২০২৩
০১:১৬ অপরাহ্ন



ঘরের মাঠই মরণফাঁদ

মিরপুরের শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম। বাংলাদেশের ‘হোম অব ক্রিকেট’। বছরজুড়ে এখানেই চলে ক্রিকেটের প্রশিক্ষণ। জাতীয় দল, অনূর্ধ-১৯ দল, নারী দল এমনকি হাই-পারফরম্যান্স দলকেও এখানেই অনুশীলন করতে হয়। আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনে প্রথম পছন্দ মিরপুর, ঘরোয়া ক্রিকেটেও তাই। ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে বাংলাদেশের ব্যর্থতার কারণও এই মিরপুর। এখানকার ধীরগতির নিচু বাউন্সের উইকেটে খেলে খেলেই দক্ষতা বাড়ে না ব্যাটসম্যানদের এবং বোলারদের, ফলে বৈশ্বিক আসরে যেখানে উইকেট থেকে সাহায্য মেলে না, তখন বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মনে হয় অসহায়।

চলছে দেশের প্রধান প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট প্রতিযোগিতা জাতীয় ক্রিকেট লিগ। মিরপুরের মাঠে অক্টোবরের ১২ থেকে ১৪ এই তিন দিনেই শেষ হয়েছে ঢাকা ও রংপুর বিভাগের চার দিনের ম্যাচ। দলীয় ইনিংসগুলো ছিল যথাক্রমে ১৬৬, ২৩৮, ২২৩ ও ১২৮ রানের। দুই দলে খেলা ক্রিকেটারদের ভেতর সাইফ হাসান, শুভাগত হোম, তানবীর হায়দারদের মতো টেস্ট খেলোয়াড়রাও আছেন। কিন্তু কোনো ইনিংসে ৩০০ রানও হয়নি, যেটা এই সময়ে টেস্ট ক্রিকেটে ন্যূনতম একটা সংগ্রহ। গতকাল এই মাঠেই রংপুর-ঢাকা মেট্রো ম্যাচের দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষ হয়েছে। প্রথম ইনিংসে দুই দলের সংগ্রহ ১১৯ এবং ১৭৩ রান, দ্বিতীয় ইনিংসে রংপুর দিনের খেলা শেষ করেছে ৬ উইকেটে ২৭৮ রানে; অর্থাৎ দুই দিনের খেলায় পড়েছে ২৬ উইকেট। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দুটো দলের প্রথম ইনিংস শেষ হয়েছে কোনো হাফসেঞ্চুরি ছাড়াই। ঢাকা মেট্রো দলে নাঈম শেখ কিছুদিন আগে এশিয়া কাপেও বাংলাদেশের ওপেনার ছিলেন, সাদমান ইসলাম, নাঈম ইসলাম, মার্শাল আইয়ুবরা টেস্ট খেলেছেন। তাদের যদি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এই অবস্থা হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কী হতে পারে, সেটা নাঈমকে দিয়েই বোঝা গেছে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের সবশেষ মৌসুমে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হিসেবে ফের জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার পর তার ব্যাটিং হয়েছে হাসির খোরাক।

ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের সবশেষ মৌসুমে মিরপুরের শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে হয়েছে ১৭টি ম্যাচ। লিস্ট-এ মর্যাদার ম্যাচগুলোতে সর্বোচ্চ ইনিংস আবাহনীর, ৫০ ওভারে ৬ উইকেটে ৩৭২ রান। গাজী গ্রুপের ৭ উইকেটে ৩০৫ রান তাড়া করে জিতেছে ব্রাদার্স, ৬ বল আর ৫ উইকেট হাতে রেখে। শেখ জামালের ২৮২ রান তাড়া করে আবাহনী জিতেছিল ৪ বল হাতে রেখে। এই হচ্ছে বড় রান এবং রান তাড়ার খতিয়ান। বাকি বেশিরভাগ ম্যাচই আড়াইশ রানের আশপাশেই হয়েছে, কখনো সেটা জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল, কখনো আবার ছিল না। মোদ্দাকথা হচ্ছে, ঘরোয়া ক্রিকেট থেকেই বড় ইনিংস খেলার বা বড় জুটি গড়ার অভ্যাসটাই গড়ে উঠছে না বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ভেতর। যার ছাপ পড়ছে এই ক্রিকেটাররাই যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে স্পোর্টিং উইকেটে বা সত্যিকার ব্যাটিং উইকেটে ভালো মানের বোলারদের মুখোমুখি হচ্ছেন। ২০২৩ সালে এই মাঠে ৪টি ওয়ানডে ম্যাচে ফল এসেছে, তাতে মাত্র একটি ইনিংস ছিল তিনশোর বেশি রানের, ইংল্যান্ড করেছিল ৩২৬ রান। বাংলাদেশ এখানে করেছে ১৭১, ১৬৮, ১৯৪ আর ২০৯ রান। প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড; অর্থাৎ ওয়ানডে ম্যাচে ঘরের মাঠেও বড় সংগ্রহ করতে পারছে না বাংলাদেশ, দেশের বাইরে পারফরম্যান্সের মান আরও নামছে।

এআরওয়াই স্পোর্টসের বিশ্বকাপ বিশ্লেষণ অনুষ্ঠান ‘দ্য প্যাভিলিয়ন’-এ নিয়মিতই আসছেন ওয়াসিম আকরাম, মিসবাহ-উল-হক, শোয়েব মালিক এবং মইন খান। বিশ^কাপে বাংলাদেশের দশা নিয়ে আকরাম জানতে চেয়েছিলেন শোয়েব মালিকের কাছে, যেহেতু গত মৌসুমে শোয়েব খেলেছেন বিপিএলে। শোয়েব তার বাংলাদেশে খেলার অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে প্রতিভা অনেক আছে, অনেক তরুণ আছে, তবে বিশ্বকাপে যারা খেলছে এরাই বাংলাদেশের সেরা। আমি ওখানে লিগে খেলতে গিয়েও দেখেছি, এই যে ক্রিকেটাররা আছে তারাই মোটামুটি নিয়মিত ভালো করে। ওখানে বিদেশের দলগুলো যখন খেলতে যায়, তখন বাংলাদেশের উচিত নিজেদের কন্ডিশনকে ভালো করা। উইকেট স্পিন সহায়ক, নিচে বাউন্সের এবং ধীরগতির। মিরপুরে যখন লিগ খেলতাম কখনো দেখেছি ২০ ওভারে ১১০ রানও কষ্ট হয়ে যেত। বল সিম মুভমেন্টও পেত আবার স্পিনও করত। চট্টগ্রাম একটা জায়গা, যেখানে উইকেট ভালো। তাদের যেসব স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হয়, সেখানে সবগুলোই প্রায় একই রকম উইকেট। ভালো করতে হলে অবকাঠামো উন্নয়নে জোর দিতে হবে।’ বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের সীমিত ওভারের ক্রিকেটে অতিরিক্ত ডট বল খেলার প্রসঙ্গে শোয়েব বলেন, ‘বাংলাদেশের উইকেটগুলোতে খেলা কঠিন। ব্যাটসম্যান সেট হতে পারে না, এ জন্য অনেক ডট বল খেলতে হয়। সেই অভ্যাসটা থেকে যায়। তাদের বেশিরভাগ রান বাউন্ডারিতেই করতে হয়, যেটা জাতীয় দলেও দেখা যায়।’

ভারতের কাছে বিপর্যস্ত হওয়ার পর ‘ক্রিকবাজ’-এর ম্যাচ-পরবর্তী বিশ্লেষণে ভারতের সাবেক ক্রিকেটার বীরেন্দর শেবাগ বলেন, বাংলাদেশের নিচু বাউন্সের ধীরগতির উইকেটের দক্ষতা পুনের মাঠে কাজ দেয়নি, ‘বাংলাদেশের বাইরে গেলে যখন ভালো উইকেটে খেলা হয়, তখন তাদের ক্রিকেটারদের দুর্বলতা বের হয়ে আসে। বাংলাদেশের বোলাররা পিচের সহায়তা নিয়ে উইকেট নেওয়ার চেষ্টা করে। যখন উইকেট থেকে সহায়তা মেলে না, তখন ক্রিকেটারের দক্ষতা কাজে লাগাতে হয়, সেই দক্ষতা আছে কি নেই, সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন। সেটা না থাকলে এ রকম ব্যাটিং উইকেটে সেরা ব্যাটসম্যানদের সামনে এ অবস্থাই হবে।’

দুই দেশের সাবেক ক্রিকেটারদের কথায় এটা স্পষ্ট, মিরপুরের উইকেটে বেশি বেশি খেলায় ব্যাটসম্যানদের সামর্থ্য কমছে আর বোলারদের ভেতর তৈরি হচ্ছে ফাঁপা আত্মবিশ্বাসের বেলুন; যা বড় মঞ্চে গেলেই ফাটছে। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে দেশে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের পর ওমানে গিয়ে স্কটল্যান্ডের কাছে হার এবং আরব আমিরাতে মূলপর্বে কোনো ম্যাচ জিততে না পারাটাই ছিল মিরপুরের উইকেটের হিতে বিপরীত হওয়ার বড় উদাহরণ। চন্ডিকা হাথুরুসিংহেও এ রকম উইকেটে অতীতে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ জিতিয়েছেন বাংলাদেশকে। তবে শেষ পর্যন্ত এসব টুকরো টুকরো সাফল্য যে ক্ষণস্থায়ী এবং বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে এলেই আসল চেহারাটা বেরিয়ে আসে, সেই সত্যিটা প্রকাশ হলো আরও একবার।

আরসি-০২